এক.
জীবন আস্ত গিলে খাচ্ছে সময়, প্রসার ঘটছে যেটুকু, সেটুকু ক্ষয়ের, বিবর্ণ দিনের মাঝে অবকাশের ঢের সময়, হাভাতের মতো আমি পথ মাড়াই না, সত্যিকারার্থে ফ্যাকাশে সময়টুকুই সঞ্চারপথের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তুলছে। স্বল্প সময়ে বিস্তর আলোচনা সম্ভব নয়, তবু জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি সজনে গাছটিতে দুটো শিশু উঠে ঝাকাঝাকি করছে, ভাবলাম নরম ডাল পতিত হলেই গেল, তাই হলো, এক জনের ঘাড়ের উপর আরেকজন, যদিও উঁচু নয় তথাপি ক্রন্দন ধ্বনি শুনে মা সোহাগ করবার বদলে নড়ি নিয়ে পিঠের উপর গুডুম গাডুম দিয়েই রাগ ঝারলেন, তারপর চিত্কার করতে করতে দুজন দুদিকে ছুটে চলল, এরা এখন মায়ের হাতের নাগালের বাইরে, আমি খাইনি,খেতে ইচ্ছে করছিল না, দুপুরে গোঁফ দাড়ি বিসর্জন দিয়ে পুরো লায়েক হয়েছি, তবে প্রকৃতি আমায় বেচারা বানিয়ে ছাড়ল, যেথা সেথা হোঁচট খাই, কাঁদায় পিছলে পড়ি, বর্ষায় যখন বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন ঠাম্মি বলল, ভাই আয় বেড়ায় আসি।
আমি ভাবলাম ঢের সময় যাওয়া যাক। লুঙ্গি সেঁটে পা টিপে টিপে চললাম, কিস্তির বহি খাতার কলম চালাচালি শেষে ঠাম্মি বলল, আয় তো, এগারে বাড়িত বলে কুটুম আইচে দেইহা আসি।
আমি বললাম, কুটুম আবার দেহার কিছু হইল, চল তারচে দেইহা আসি খ্যাতে জল আইছে কিনা!
ঠাম্মি বলল, ররো মদ্দা, যাই।
কি করার, পিছু অনুসরণ করে শুধু বাড়ির উঠোন পর্যন্ত গিয়েছি, ওমনি ধপাস!
তারপর রাঙা মুখ নিয়ে কোনোরকমে উঠে বাইরে চলে আসি, পিঠে কাঁদা, চুলে কাঁদা, লজ্জা পেলাম গেরস্তের কুটুম্ব মুখ টিপে হেসে কুটপাট, মনে মনে বললাম, পড়লে ঠেলা বুঝতেন।
এরপর খুরিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি কলার মোচা কেটে বাড়ান্দায় জড়ো করেছে, গাছে বাঁশ গেঁথে ভেলা বানিয়ে মাছ ধরার নানা কৌশল করছে এই সবেকার ছেলেরা।
দুই.
ঘোলা জল, তার উপর মেঘলা আকাশে গা শির শির করে, ওদের বাইড়া বুঝ দিয়ে বললাম, যারে, আইজ আর যাবো না, স্রোত বেশি, বাঁশ খাটপি না।
ওরাও চলে গেল, কিন্তু টিউবওয়েলে স্নান সেরে কাঁথার ভেতর দেহখানি পুরে আজব চিন্তায় মশগুল, ধ্যান ভাঙল তখন যখন কপালের উপর টপ টপ করে জল পড়ছিল, আহ বিরক্তি, টিনের ছ্যাদা দিয়ে জল পড়ছে, কবেকার পুডিং খসে পড়েছে, মাচার উপর হাড়ি পাতিলের ভেতর ইঁদুর কুটকুট করে খাচ্ছে, বেড়ার উপর সাপ এসে উঁকি মারে, গোয়াল ঘরে সাপের বৈঠক, ওরাই বা কি করে, জলের তলায় বাড়িঘর, তাই আশ্রয় নিতে আসা, ভাগ্যিস এরা বিষধর নয়। তারপরেও গায়ের উপর উঠে এলে বুক ধরফর করে, বাবাকে বললাম, আমি আসি, টাকাটা ওহোনেই পাঠায় দিয়েন।
যাবার সময় ঠাম্মি বলল, ছ্যাড়া। আর কদ্দিন থাইকা গেলু না?
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম, কদ্দিন বাদেই আসপো।
হঠাত্ এরকম স্মৃতি ভেসে উঠলে বুকটা খাঁখাঁ করে, কিসে পড়ে আছি, কিইবা উদ্দেশ্য! খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস এসে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দিচ্ছে, কদিন ধরে রুম থেকে বেড়োইনি, দোকানে সিগারেট আনতে গিয়ে দেখি সবাই ঝেঁকে ধরেছে, আরে কই ছিলি। তোরে দেখা যায় না।
আমি ভিড় সামলিয়ে বলি, পরে কথা হবে।
বড় ভাইয়েরা অবশ্য বেয়াদব বলে স্বীকার করে নিয়েছে, উনারা সবর্দা আদাব কাদাব চায়, সামনে সিগারেট টানলে মান যায় জাত যায়, তাই পারলে রুমে গিয়ে নানা থেরাপি দিয়ে যায় মিশু, শুভ্রকে। আমায় একবার থেরাপি দিতে এসেছিল, তারপর আর আসেনি, উনারা এদ্দিনে জেনে গেছে, থেরাপি সর্বদা শুভ হয় না, তাই শুকনো লঙ্কার গুড়ো চোখে ছিটিয়ে উল্টো থেপারি দিতে ভুলিনি, বাক-বিতণ্ডায় জড়াইনি, শুধু বলেছিলাম, বড়ত্ব ঘাড়ে তোলেন, আপনি না স্যারের সামনে বিড়ি নিয়ে ভাব দেখান। তাঁরা কী আপনার চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন?
তাই শিক্ষেটা হজম হয়েছে, বাড়িতে পিসির গুরুদেব এসে ঠাঁই নিয়েছে, দুদিনে বাড়িকে আশ্রম বানিয়ে তুলেছে, এরপর নোঙরখানা, বাবা বলল, আমি গ্যালেই সব চুইপসা যায়, গুরুদেবেক কইলাম, গুরুদেব আইসেন মাছ খায়আ যান। হেহে।
মোবাইল রেখে বুঝলাম, গুরুদেব গোস্বা করলেও বিদেয় হননি, কারণ এ পথ দিয়েই তীর্থে যাবেন, সবটাই বিক্রি করে ভারতে চলছেন। সন্দেহ নেই, স্ত্রী পুত্রদের পূর্বেই রেখে এসেছেন, দলিল পর্চা আনুষাঙ্গিক কর্ম সেরেই যাচ্ছেন।
তিন.
এই নিয়ে তৃতীয়বার ছ্যাচড়ারা রুমে রুমে মিটিং বসিয়েছে, তখন সন্ধ্যে, বালিশে মাথা গুজে কাব্যের রসালো রস চুমুক দিয়ে পান করছি, মাথায় লাটিমের মতো ঘুরছে শব্দ, আমি ঠিক ভণিতা আর নাট্য নট ইত্যাদি বিষয়কে পরিহার করেছি, ছ্যাবলামিতে পরিপূর্ণ, তাই সাড়া না দেয়া কোকিলা সুকণ্ঠীও বেজায় খুশি, তার আর দায় নেই, ঠাঁই দিতে পারেনি, কারন তার পিতার অগাধ সম্পদে(কণ্যা) মহান ব্যাটাছেলের প্রয়োজন, আমি রুইকাতলা প্রতিযোগী হলে প্রথম রাউন্ডের বাছাই পর্বেই বিদেয়, এমনি মস্তিষ্কে সবর্দা বিক্রিয়ারত কোকিলাও সুর্দশন কামদেবের সহিত হৃদয়াসন বিকশিত করবে, আমিও আর্শীবাদসূচক বাণী দিয়ে মনজগত থেকে টেনে বের করে দিয়েছি।
ম্যাথমেটিসিয়ান হবার ইচ্ছে রাখি, তাই সাদা কাগজে বড় অংক কষে সান্নিধ্য লাভ করি নিউটন অয়লার আরও কতকের, যদিও মাধ্যমিকের গণিত ঠাহর করতে পারিনা, রুম মেট মশকরা করে বলে, পান্ডিত্য আর যাই হোক,সাজা চলে না।
আমিও ব্যাকরণ হতে প্রশ্ন তুলে অযোগ্যতাকে যোগ্যতায় পরিণত করি, তবে হালে আমার যথেষ্ঠ আছে, তবে কিঞ্চিত্ স্বাতন্ত্র্য।
এখন রুদ্ধ দুয়ার খুলে রেখে দিই, পূর্বের মতো কেউ দাদা দাদা বলে বিছানায় বসে বলে না, চলো, ক্রামে হাত দিই।”
আমি শাসিয়ে দিইনি কখনো, ধীরে ধীরে ওরাই ভুলে গেছে,এখন ঘুমোলে হুশ পাইনা, হল্লাহাটিও কম, সবাই কী আমার মতোই নিথর প্রাণী?
বাড়ি থেকে মা বলেছিল, গ্যাদা কবে আসপি? শরীর ভাল আছে তো? খাইছু? আইসা দেখ, তোর আম গাছটা কত বড় হয়আ গ্যাছে, ছাগল আর মুখ দিবার পারবি নানে।”
আমি রাখি বলে ফোন কেটে সিগারেট জ্বালাই। পা দুটি ঝাকিয়ে সুর তুলি, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শিশু দুটি আবার সজনের ভাঙা ডাল দুটিতে চরে মোটর মোটর খেলছে,ভু ভু ভু।
সজনের ছোট ছোট সবুজ পাতায় সৌন্দর্য আছে, সকালে উঠলে দেখি মগডালে একটি কাক চুপচাপ গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে, আশে পাশে যান্ত্রিক যন্ত্রগুলো অনবরত অভিনয় করে, যেন একই প্রোগ্রাম সেট করে দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, উঁচু দালানের পাশের হোটেলটি থেকে ধোঁয়া ওঠে, মানুষ বসে যায়, খায়, গপ্প করে, আমার যাওয়া হয় না, খিদে মরে গেছে, আমার মতোই, শুধু চা শুধোলে আর থাকতে পারিনা, টঙের দোকানে পা তুলে ভদ্দর লোকদের আনাগোনা দেখি। দিন যায়। কাকটিও আর ফিরে তাকায় না, ওর চিন্তা জগত আরো স্বতন্ত্র, অনেক ক্ষণ থাকে সে, তবে কোনোদিনও দেখা হয়নি সে কখন উড়ে যায়।
ভীষ্মদেব সূত্রধর-জন্ম ১৯৯৬ সালে। পঞ্চগড়, বাংলাদেশ।