বন্দী জীবন হলেও তিনবেলা পেট পুরে খাবার খেয়ে দিব্বি কাটছিল পাখিটির। হ্যাঁ, সপ্তাহ খানেক আগেই মানুষ রূপী নিষ্ঠুর শিকারীর পাতা ফাঁদে ধরা পরে ঘুঘু পাখিটি।
সদ্য ফসল সংগ্রহ করা সরিষা ক্ষেত থেকে শষ্য খেয়ে মনের আনন্দে ভয়ডরহীন ঘুঘু পাখিটি একদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো এডাল থেকে ওডালে। অভিজ্ঞতাহীন পাখিটি ছোট একটি গাছের ডালে বসে হঠাৎ লক্ষ্য করে, তার পা যেন আর নড়ছে না, কোনো কিছুর ভেতর আটকে গেছে। অনেক টানাহেঁচড়া করে, ঠোঁট দিয়ে অনেক ঠোকর দিয়েও কোনো লাভ হলো না। ঘুঘু… ঘুক করে অনেক ডাকলো সঙ্গীদের। সঙ্গীরা সবাই সেই পাখিটিকে খুব ভালোবাসতো। তারা সবাই ছুটে এলো। কিন্তু এলেও শুধু দেখা ছাড়া কিছু করার মতো উপায় ছিলো না তাদের। অবশেষে যা হবার তাই হলো, শিকারী এসে ধরে ফেললো পাখিটিকে। মনে মনে সে ভাবলো আজকেই বুঝি তার জীবনের শেষ দিন।
ঘুঘু পাখিটির ভাবনা কিছুটা মিথ্যা করে শিকারী তাকে ধরে এনে খাঁচায় ভরে রেখে দিলো। ঝুলিয়ে রাখলো বাড়ির বারান্দার চালের সঙ্গে। খেতে দিলো তার পেটের আয়তনের চেয়ে অনেক বেশি খাবার ও পানি। বিষয়টি পাখিটির মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না। কেনইবা ধরা হলো তাকে, কেনইবা মেরে না ফেলে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, কেনইবা এতো এতো যত্ন-আত্তি করা হচ্ছে?
পাখিটির মনের অফুরান আনন্দ, ঠোঁট ভরা মিষ্টি গান আর স্বতঃস্ফূর্ততা ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগলো। বারান্দায় খাঁচার ভেতর বসে থেকে সে দূরে পরিচিত গাছ, মাঠ ও আকাশ দেখতে পায়। দেখতে পায় সঙ্গীদের কেও, আর হারিয়ে যায় অতীত কল্পনার জগতে। সবটুকু শক্তিদিয়ে সে চেষ্টা করে সঙ্গীদের কাছে ডাকতে।
একদিন সকালে ঘুঘু পাখিটি অদূরে একটি উঁচু কড়ই গাছের ডালে তার এক কাছের বন্ধুকে দেখে ডাকতে থাকে, ঘুক..ঘুঘু..ঘু…। তার সে ডাক বন্ধুটি শুনতে পেয়েছে কি না তা জানা যায়নি তবে শিকারী যে শুনতে পেয়েছে সে ব্যাপারটি নিশ্চিত। শিকারী খাঁচাটির খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কালো রংয়ের ছোট একটি বস্তুকে গভীর মনোযোগে টিপতে থাকে। পাখিটি থামে, কিছুক্ষণ দেখে আবার নির্ভয়ে ডাকতে থাকে, ঘুক..ঘুঘু..ঘু…।
তার কিছুদিন পর, একদিন খুব সকালে শিকারী লোকটি পাখিটিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরে পাশের গ্রামের উদ্দেশে। অনেকদিন একই জায়গায় থেকে থেকে পাখিটি হাঁপিয়ে উঠেছিলো। সে কারণে এবার একটু মুক্ত বাতাসে সে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। কিন্তু সে জানে না তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বা কী উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শিকারী লোকটি পাখিটির পায়ে একটি সুতা বাঁধে। তারপর তাকে ফাঁদের সঙ্গে বাঁধে। এবার পাখিটি কিছুটা ভয় পেয়ে যায় এবং বুঝতে পারে কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ ফাঁদ নামক জিনিসটি তার চেনা হয়ে গেছে। তবে কী হতে চলেছে সে ব্যাপারটি তখনও সে বুঝে উঠতে পারে না।
একটি লম্বা লাঠির মাথায় প্লাটফর্মের মতো দেখতে ফাঁদটি। সুতার সাহায্যে তৈরি প্লাটফর্মটি আবার লতা পাতা দিয়ে ঢাকা, যেন সহজে কেউ বুঝতে না পারে যে সেটি ফাঁদ। লতাপাতা আবৃত সেই প্লাটফর্মের সাথে বাঁধা হয় পাখিটির পায়ে বাঁধা সুতা। পাখিটি কয়েকবার পাখা ঝাপটিয়ে চেষ্টা করে উড়বার জন্য কিন্তু পা যে সুতায় বাঁধা। খুব বেশি হলে সে লাফালাফি করতে পারবে কিন্তু উড়তে পারবে না।
একটি বড় মাঠের কাছাকাছি ছোট একটি আম গাছের মধ্যে বসানো হয় ফাঁদটিকে। ভয়ে দুরুদুরু বুক আর উৎকণ্ঠা ভরা চোখে দেখতে থাকে পাখিটি, এগুলো কী হচ্ছে তার সাথে! হঠাৎ সে চমকে ওঠে আর এক শব্দে। কে যেন খুব জোরে জোরে ডাকছে তার বন্ধুকে। কিন্তু কে ডাকছে এমন বুক উজার করা কণ্ঠে? কাকেইবা ডাকছে?
আরে! এতো তারই কণ্ঠ! সে-ই তো একদিন ডেকেছিলো তার প্রিয় বন্ধুটিকে। কিন্তু সেই ডাক এখন কীভাবে শুনতে পাচ্ছে সে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না পাখিটি। অথচ সেই ডাক শুনে ছুটে আসছে অন্য ঘুঘু পাখিরা। পাখিটি খুব চেষ্টা করে তাদের থামাতে, বোঝাতে চেষ্টা করে যে, সে ডাকছে না, এবং এখানে আসলে তাদেরই বিপদ হতে পারে। কিন্তু উচ্চ স্বরে বিরতীহীনভাবে সেই ডাকের কাছে তার সব চেষ্টা ব্যার্থ হতে লাগলো। ছুটে এলো অন্য অচেনা ঘুঘু পাখি। তার কাছাকাছি বসতেই ফাঁদের সঙ্গে জরিয়ে গেলো সেই পাখিটির পা। ছটপট করতে করতে অচেনা পাখিটি বলতে থাকে, ‘তোমার মতো এতো খারাপ পাখি আমি দেখিনি কোনোদিন। তুমি আমাকে ডেকে এনে এভাবে আমার সর্বনাশ করতে পারলে? তুমি পাখি সমাজের কলঙ্ক। নীচ, শয়তান, রাক্ষসী..’ ঘুঘু পাখিটি কোনো ভাবেই বুঝাতে পারে না যে, এ ডাক সে ডাকেনি। মানুষ যে কতো ধূর্ত হতে পারে, কতো খারাপ হতে পারে, কতো নীচ হতে পারে তা তার জানা ছিলো না।
এভাবে দিনের পর দিন শিকারী ঘুঘু পাখিটিকে ব্যবহার করে, তার কণ্ঠ মোবাইলে রেকর্ড করে এবং বাজিয়ে পাখি শিকার করতে লাগলো। প্রতিটি পাখি ফাঁদে আটকানোর পর শিকারী লোকটি ফাঁদটিকে নামিয়ে পাখিটিকে খুলে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে কিছুক্ষণ বন্দী করে রাখে খাঁচায়। বেশ কিছু পাখি ধরা হলে, শিকারী সেগুলোকে অন্য মানুষের হাতে তুলে দেয়, বিনিময়ে কাগজের মতো কিছু একটা নেয়। তারপর তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা সে জানতেও পারে না। সব কিছুই টোপ হিসেবে ব্যবহৃত ঘুঘু পাখিটির সামনেই ঘটে। পাখিটি প্রথম দিকে সব কিছু পরিষ্কার না বুঝলেও এখন সে অনেকটাই বোঝে। কিন্তু বুঝলেও সে নিরুপায়। প্রতিটি পাখির জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করে, ক্ষমা চায় কিন্তু তার পরেও প্রতিটি পাখি তাকে প্রাণভরে অভিশাপ দিতে দিতে চলে যায়। এগুলো ঘুঘু পাখিটির মোটেও ভালো লাগে না। সে ভাবে এভাবে তাকে ব্যবহার না করে খাঁচায় শুধু বন্দী করে রাখতো তবুও ঢের ভালো ছিলো। এ কাজের জন্য সে খাঁচার বাইরে আসতে চায় না। তার খুব কষ্ট হয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেটাও পারে না। নিজেকে ফাঁসিযোগ্য আসামী বলে মনে হয় তার। কিন্তু সে কি আসলেই দোষী, সে কি আসলেই ফাঁসিযোগ্য আসামী পাখি?