স্নিগ্ধ হাসির সাথে দেখা করে আসি
কিছু কান্না জমিয়ে রাখি, যাতে আস্তে ধীরে
সময় নিয়ে পরে কাঁদা যায়। মানুষ যেমন একটু একটু
করে টাকা জমায়, তারপর দূরে কোথাও বেড়াতে যায়
তেমন করে আমি কান্নাগুলোকে জমিয়ে রাখি।
যেদিন হয়তো সময় করতে পারবো কান্নাগুলোকে কাঁদার,
সেদিন মর্সিয়া হবে, কারবালা নামবে পৃথিবীতে
আর আমি সবাইকে পান করতে দেবো ইক্ষুরসের মতো এক গ্লাস
নিরেট অশ্রু। এটা সেটা ঝামেলায় কান্নাগুলোকে
আমি বারবারই উপেক্ষা করি, বলি পরে আসতে।
যেমন ফিরে যায় বিমুখ ভিখারি। আর আমি
সৎ মায়ের মতো তঞ্চকতা করে ভালোবাসি নিজের
আনন্দ সন্তানগুলোকে। অবিরাম কান্নার সেই ক্ষণ
শুধু পেছাতে থাকে যেমন পেছাতে থাকে
সরকারি অফিসের কাজ। এমন করে তাকে ফাঁকি দিয়ে
আমি কি গোপনে গোপনে চলে যাচ্ছি মৃত্যুর
সদরগেটের দিকে? একটা জীবন দীর্ঘ স্বপন
পার করে ফেলবো কান্নাকে এড়িয়ে চলে?
বাইরে চড়ুই পাখি ডাকছে চড়ুইভাতিতে, বৃষ্টি না হলেও
এই শীতে কুয়াশারা জল দেয় গাছে। প্রবল একটা কান্না
ঘূর্ণিপাক খেতে থাকে মস্তিষ্কের সবুজাভ আকাশে
আর আমি তাকে বলি: পাঁচটা মিনিট সময় দাও,
একটু স্নিগ্ধ হাসির সাথে দেখা করে আসি…
উৎকর্ষতার পাহাড়
প্রিয় আয়না, বলো আমি আর কতো উৎকর্ষ হবো?
উৎকর্ষতা জমাতে জমাতে হবো কি
উৎকর্ষতার পাহাড়? কি লাভ বলো সেই পাহাড়
ট্রেকিং করতে যদি না আসে কোন বিস্মিত আগন্তুক?
কিংবা এক ঝাঁক তরুণ তরুণী বা কোন মিষ্টি
হাঁসের পরিবার? উৎকর্ষতার পাহাড়ের ভাঁজে
তারা ডিম পাড়বে, বাচ্চা ফুটবে, ছোট ছোট লাল ঠোঁটে
পাহাড়ি লতাপাতা তারা ছিঁড়ে খাবে কিংবা আকাশের
মতো নীল সরোবরে সাঁতার কাটবে জীবনের
চড়াই উৎরাই ভুলে গিয়ে। পুষ্প আপনার জন্য ফোটে
নাকি ফোটে না, এটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই আজকাল।
দুইটাই তো ঠিক, তবে পাশে কোন বিস্মিত আগন্তুক
না থাকলে উৎকর্ষতার পাহাড়েরও মন খারাপ লাগতে পারে।
আকাশে বাতাসে যদিও একটাই শ্লোগান: উৎকর্ষতা!
যে গাছের ফল ঝরে যায় প্রথম বছর, পরের বছর
তার ডাল ঝুলে পড়ে ফলের ভারে। প্রকৃতির সব চেহারায়
গ্রাফিতির মতো করে আঁকা ” উৎকর্ষতা”। হাঁটতে গিয়ে
রাস্তায় দেখি চক দিয়ে বড় করে কেউ লিখে রেখেছে:
উৎকর্ষতা। ডানে বামে সামনে পেছনে যারা ছুটছে
নীরব যুদ্ধক্ষেত্রে বা ফুল কাননে, জার্সির পেছনে নাম
লেখার মতো তাদের সবার পিঠে লেখা: উৎকর্ষতা!
উৎকর্ষতা অবশ্যম্ভাবী, কোন মুগ্ধ আগন্তক
সেই উৎকর্ষতার পাহাড়ে বেড়াতে আসুক বা না আসুক।
হাছন রাজার গান
কিছু কিছু দিন হাছন রাজার গান শুনে
কাটিয়ে দেয়াই ভালো। অনেক আধুনিক মানুষের
ভিড়ে যেন এক বায়বীয় বৃদ্ধ গায়ক একতারা বাজিয়ে
গেয়ে চলে গান না, গভীর অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া
হরিণের মতো ধরে আনে মনের কথা।
পাশের বন্ধুটির শিকড়ে কুঠারের আঘাত হানার দিনে
সুর করে পড়ি বনায়নের মন্ত্র। যতো কারচুপি
ফেলে দিয়ে ডাস্টবিনে কুড়িয়ে আনি ডানার পালক,
পিঠেরও অলঙ্কার দরকার বলে। চাঁদের দিকে বাড়িয়ে
দিই মই, চাঁদে যাবো না- চাঁদকেই বলবো মই বেয়ে
নেমে আসতে। সৌন্দর্যের ধারণা ছিল না বলে
অন্ধ কিশোরী সারা মুখে মেখেছিল জ্যোৎস্নার
ফেসপ্যাক। আর আমি বিরহ ভুলতে এক
প্রবীণ বায়বীয় গায়ককে হাত ধরে নিয়ে আসি
জোছনাগলা মেঠোপথ থেকে আমার অমাবস্যার ঘরে।
বলি, আজ সারা রাত আপনার গান শুনবো।
“ভাবতে ভাবতে হাছন রাজা হইলো এমন আউলা” শুনবো।
লুবনা চর্যা– কবি। জন্ম: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১। জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: জিওগ্রাফি ইন অ্যা জ্যু…, শয়তানের অভিনব কারখানা, পপকর্ন, চিন্তাশীল মেশিন, এবং হেমন্ত’কে বলা এলোমেলো কথা (২০২১)।