জুম স্বপ্নে বিভোর আদিবাসী মেয়েটাও একদিন হারিয়ে যাবে
জুম স্বপ্নে বিভোর আদিবাসী মেয়েটাও একদিন হারিয়ে যাবে
রাজপথে মুষ্টিবদ্ধ বোমারু, লাল হাতের সমাবেশ, শিমুলের ন্যায় রঙিন পরিচিত মুখদের স্লোগান, খরা রোদের বেপরোয়া অজস্র কাব্য কিংবা
লাল কাপড় মাথায় বেঁধে প্রাণখুলে অধিকার হারাদের পক্ষে ঠোঁট মেলানো ছেলেটাও দায়বদ্ধতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে খুব অজুহাতে
মাথা নত করবে প্রখরতাহীন পরাজিতার লগ্নে।
একদিন পাহাড়ে আর্তনাদ হাহাকারেরা স্বরুপে ফিরবে
বিভীষিকাময় জুমের মেঠোপথ পেরিয়ে
বরগাঙ তার সৌন্দর্য হারাবে, আমার বাড়ির ভিটেয় ভূমিখেকো শকুনেরা এক পসরা আসর জমাবে
আর আমি মরণকান্নায় মত্ত হবো স্মৃতিকে আগলে রেখে,
হয়তো বনরুপার পেট্রোল পাম্পে হাজার লোকের জমায়েত ঘটবে
দখলদারত্বের প্রতিবাদ মিছিলে
কিন্তু সমাধান স্থায়ী করতে এগিয়ে আসবেনা কেউ….।
হয়তো কেউ চলে যাবে জুমের বিপরীত স্রোতে, হয়তো থমকে যাবে রাধামনের বুদ্ধিদীপ্ত তলোয়ার
বিবেক কথা বলবেনা অধিকার হারাদের পক্ষে
সব কৃত্রিমতা শোভা পাবে অসারে
শঙ্খ নদীর অপূর্ণতায় বিষাক্ত বসন্ত বিলাসে হারাবে
দূষিত হবে পাহাড়, দূষিত হবে সংস্কৃতি।
একদিন, উচ্ছেদ বিতাড়িত অনলে পোড়া ইস্পাত বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ মেয়েটাও শেষে বলে উঠবে
আর কতদূর?
সেও একটু জিরিয়ে নিবে
নিঃশ্বাসের জনাব-বেগম তকমা সম্মীলনে।
বিভীষিকা ময় অন্ধকার
অসার জুমের মেঠোপথে
কল্পনা অার আসবেনা….
যদি তুমি চুপ হয়ে যাও
যদি তোমার স্বপ্নদের পাহাড় ডিঙিয়ে আকাশে উড়তে না দাও
যদি বরগাঙের কান্না না থামাও
যদি ক্রাউডংকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না দাও
সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে
চেতনার স্ফুলিঙ্গ বাজবেনা আর পাহাড়ে পাহাড়ে।
….. তোমার খোঁপায় নাকশা ফুল গুজিয়ে দেয়া হবেনা অার
মেঠোপথ ডিঙিয়ে হরিণা মোন উঠা হবেনা তোমার হাত ধরে
যদি পিছু হটো নিরবে
সবকিছু….
সব কিছু থেকে যাবে অসারে।
অসহায়ত্ব
একদিন খুব শীতের ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে এক অসহায় ছিন্নমূল শিশুকে কনকনে শীতে কাঁপতে দেখেছিলাম
শিশুটির ছিন্ন বস্ত্র বারবার আমার দিকে তাকিয়েছিল
কিন্তু জবাব দেওয়ার মত যোগান আমার কাছে ছিল না।
একবার খুব তাড়া করে ক্লাসে যাওয়ার সময় একদল লোক এক সিএনজি চালককে মারতে দেখেছিলাম
সম্ভবত চাঁদা না দেয়ার অভিযোগে।
ডজনখানেক লোক জড়ো হয়ে দেখছিল হুজুগে মস্তিষ্কে
আমিও সেদিন আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের কথা ভেবে সামর্থ্যের বাইরে যেতে পারিনি।
একবার ক্যাম্পাসের এক বড়ভাইকে নিরাপত্তা প্রহরীর এক কর্মীকে কড়া ভাষায় শাসাতে দেখেছিলাম
চাকরী হারানোর ভয়ে প্রতিবাদের ভাষা চুপসে যাওয়ায় নীরবে চোখের জল পড়তে দেখেছি সেদিন।
এদেশে ক্ষমতার অপব্যবহার চলে বলে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাইনি আমি ।
একবার আমরা পাহাড় থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম
কিন্তু নানান অজুহাতে আমাদের সমাবেশ করতে দেয়নি।
অথচ আমরা কয়েকদিন হলো ওখানে শাটলে বগি বৃদ্ধির দাবিতে মিছিল করেছিলাম।
এই বিষন্ন শহর এখন আমার
এখানে স্বপ্নেরা ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারেনা
হাজারো স্বপ্ন ছাই হয়ে যায় ক্ষমতার দহনে পুড়ে পুড়ে।
এরকম এর চেয়ে বেশি আমার পাহাড়ে হয়
সেখানে ভূমি খেকোদের কবলে পড়ে শত শত একর ের জমি সকাল হলে নাই হয়ে যায়
সেখানে জুম্ববির আর্তনাদ পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হয়
সেখানে আমাকে মেরে ফেলা হয়,আমার সত্তাকে মেরে ফেলা হয়,আমার স্বপ্নকে মেরে ফেলা হয় প্রতিটি পদে পদে।
আমার শব্দচাষ পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোন এক ওপেন সিক্রেট দাবাড়ুদের রোষানলে।
সবকিছু তোমার জন্য
তুমি এসো,
পাহাড়ের মেঠোপথে খুব সকালে কিংবা সূর্য ডোবার আগে
তোমার হাতটা ধরে খুব শখ করে হাঁটব।
চাঁদের লুকোচুরি খেলায় জোনাকিরদের আড়ালে রেখে
ধার করে কেনা হাজারো তারাদের নিয়ে তোমার পিছু নেব
যদি হাতটা ছাড়ো।
হে প্রিয় তুমি এসো,
হাজারো সবুজ খাম তোমায় দিব
মাতাল মন ভাসাবো কবরক ধানের সুভাসে
জুমের ঘোরে মাতবো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
তুমি এসো,
জুম প্রেয়সীর ন্যায়
নাকশ ফুল খোঁপায় বেঁধে প্রাণে প্রাণ মেলাবো
অরিঙা মোন পাড়ি দেবো মাইলের পর মাইল
চুম্বক ঘেঁষা জুমের শহরে।
কিছু টান,স্বার্থপরতা, কিছু আবেগ,ভালোলাগার ফুলটা তোমাকে দেবো
আমার স্বর্গের টানে যদি তুমি আসো।
আমার ধ্যান শুধু তোমার জন্য,
আমার স্বপ্ন,আমার পাড়ি দেয়া তোমার জন্য
বার্গীদের সাথে আকাশ ছুঁয়ে দেখা
সবকিছু তোমার জন্য।
ম্যাকলিন চাকমা-পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণ কবিদের একজন। তাঁর জন্ম ১৯৯৩ সালের ১০ অক্টোবর রাঙামাটি জেলার সুভলং ইউনিয়নে। তাঁর ১০ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনটি কাব্য গ্রন্থ বেরিয়েছে। সম্পাদনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাহিত্য ম্যাগাজিন “রঁদেভু” ১৭তম সংখ্যা। কবিতা লেখার পাশাপাশি চাকমা ছোটগল্পও লিখছেন। তাঁর একটি চাকমা ছোটগল্প ও দুটি কাব্যগ্রন্থ (একটি চাকমা ভাষায়, অপরটি বাংলা ভাষায়) প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। আদিবাসী সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বরুনাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি কর্তৃক তিনি তরুণ কবির সম্মাননা লাভ করেন। এছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য।