দুটি গোরুই জবাই হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন চলছে মাংস কাটার কাজ। মাটিতে চট বিছিয়ে তার উপর কলাপাতা মেলে দেয়া। তারই চারপাশে ধারালো দা, বটি, ছুরি, চাপাতি দিয়ে মনের সুখে মাংস কেটে চলেছে চেয়ারম্যানের বারমাসি কামলারা। আজ এদের অনুভূতি প্রকাশের ভাষাতেই বোঝা যাচ্ছে― আজ ঈদ! তারা আজ বিড়ির বদলে স্টার সিগারেট টানছে। একে অপরের সাথে মেতে উঠছে অনর্থক অশ্লীল কৌতুকে। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে কাজ ঠিকভাবে করার নির্দেশ দিচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়েই কলাপাতার বিছানা ভরে উঠছে মাংসের স্তুপে। চেয়ারম্যান নিজে কখনও মাংসের তদারকি করেন না। বিশেষ করে যে গোরুটা শুধুই সমাজের জন্য কাটা হয়। যাবতীয় কর্তৃত্ব তার কামলাদের। কামলাগুলোও সেই কর্তৃত্ব খাটায় যে যার মত। যেন চেয়ারম্যান বাড়ির কামলারাও একেকজন চেয়ারম্যান। না হয় অন্তত মেম্বার! তারপরও চেয়ারম্যান সাহেব এক দুইবার এসে মাংসের পাহাড়ের পাশে একদন্ড দাঁড়ান। সাথে সাথে তার বসার জন্য নকশা করা গদি লাগানো চেয়ার আসে। কিন্তু তিনি বসেন না, চলে যান। এলাকার বিভিন্ন কুরবানীর স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। যাবার আগে সবার উদ্দেশ্যে একবার শুধু বলে যান, “কাজ কাম ঠিকমত করিসরে তরা…।” এই কথার কোন জবাব চেয়ারম্যান প্রত্যাশা করেন না। তবু জবাব দেয় কালুর বাপ। লুঙ্গিটা নেংটির মত করে কাছা দিয়ে, হাড় জিড়জিড়ে বয়স্ক কালো শরীর উদোম করে দুই পায়ের উপর বসে সে মাংস কাটছিল। সে তার পান খাওয়া কালো, উঁচু দাঁতগুলো বের করে হেসে হেসে বলে, “কুনো চিন্তা কইরেন না চেরমেন সাব। ব্যাবাগ কাম সামাল দিমু।” কালুর বাপের কথাগুলো চেয়ারম্যান শুনলেন কিনা বোঝা যায় না।
মাংস কাটার স্থানটির পাশেই একটা নতুন স্টীলের গামলা বুকে জড়িয়ে বসে আছে সাত-আট বছর বয়েসী একটি মেয়ে। বাবা নেই, মা নেই। নানীর কাছে মানুষ। মেয়েটির মাথায় তেলে ভেজা চুলে সিথি কাটা। গায়ে মলিন একটা ফ্রক যার কাঁধের কাছে ছেঁড়া। পায়ে নতুন রাবারের স্যান্ডেল। গোরু জবাই হবার অনেক আগে থেকেই মেয়েটি এখানে এসে বসে আছে। তার পাশে বসে আছে একটি কুকুর। মেয়েটি কেন এখানে সকাল থেকে বসে আছে তা সবাই জানে। তবু মাংস কাটার কামলারা ‘সে কেন এখানে এসেছে?’ প্রশ্নটি বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্বকভাবে তার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর একেকজন হাসিতে ভেঙে পরছে। মেয়েটি হাসতে পারছে না; কাঁদতেও পারছে না। প্রতিবাদের কোনও শব্দও সে ঐটুকু মুখে উচ্চারন করতে পারছে না। তাই হাতের গামলাটা বুকে ধরে মলিন মুখে নিশ্চুপ বসে আছে সে। তার পাশে বসা কুকুরটা কিন্তু চুপ করে বসে নেই। মাঝে মাঝেই মাংসের স্তুপ থেকে এটা সেটা ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। কুকুরটা পরম উদ্যোমে ছুটে গিয়ে সেসব ভোজন করে আসছে। এসে আবার নবাবী ভঙ্গীতে বসছে মেয়েটির পাশে। কুকুরটির এই ভোজন পর্ব দেখে মেয়েটি আবার একমনে অপলক তাকিয়ে থাকে মাংসের স্তুপের দিকে।
এক সময় মাংসের ভাগ বাটোয়ারা শেষ হয়ে যায়।অনেক মানুষ বালতি আর গামলা ভর্তি করে মাংস নিয়ে গেছে। ভিড়ের কোণে চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটির দিকে কেউ একবারও তাকায়নি। তবু মেয়েটি একটা কথা বলার সাহস পায়নি, চলেও যায়নি। ঐ স্থানটিতে এখন শুরু হয়েছে আরেক নাটক। এতক্ষন নিজামুদ্দিনই ভুঁড়িটার একক দাবীদার ছিল। এখন হাসুর বাপেরও অর্ধেক চাই। ওদিকে কালুর বাপ চারটি ক্ষুরের একটিও অন্য কাউকে দিতে রাজী নয়। এই নিয়ে সেখানে একটি হট্টগোলের মত বেঁধে যায়। এমনই পরিস্থিতিতে মেয়েটির উপর চোখ পড়ল তাদের।
ঃঐ ছেরি, এ্যাহোনো বইয়া অইছস ক্যা ? একজন বলে
ঃ বইয়া অইছে ক্যা বুজনা? গোস্ত নিবো; তারে এ্যাক ডিশ গোস্ত দিয়া দ্যাও! আরেকজন যোগ দেয়
ঃ এ্যাহ্ গোস্ত নিবো! গোরু মনে অয় চ্যারমেন অর জন্যে জব দিছে? যা ফকিন্নীর বাচ্চা ভাগ!
মানুষ এমন তবে? হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতাতেই সে ভুলে যায় তার নিজের অবস্থান? স্বজাতির চামড়া ছিঁড়ে খেতেও বুঝি তখন তার আর বিবেকে আটকায় না !
ধমক খেয়ে মেয়েটি কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। মেয়েটি উঠে চলে যতে চায়, ঠিক তখনই কেউ একজন বলে, “আরে তরা হুদাই চিল্লাস ক্যা? ম্যায়াডার হাতে অবা করতাছস ক্যা তরা? আইজ একটা ঈদের দিন, দিয়া দে দুই টুকরা । হেই সক্কাল থিকা আশা নিয়ে বইয়া অইছে।” এই কথা শুনে মেয়েটি আর উঠে চলে যেতেও পারে না আবার বসতেও দ্বিধা চলে আসে খুব।
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই কেউ একজন মাংসের কিছু অংশ তার গামলায় ছুঁড়ে মারে আর বলে, ‘যা নবাবের বেটি গোস্ত খা গিয়া!’ ঢিলের ধাক্কায় গামলাটা মেয়েটির হাত থেকে পরে যায়। শুকনো ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যায় না মাংস না চর্বীর দলাখানি। মেয়েটি সেটাই আবার গামলায় তুলে নেয়। কিন্তু আশ্চর্য, কুকুরটা পাশে বসা থাকলেও একবারও মেয়েটির পরে যাওয়া মাংসের দিকে তাকায় না!
তবে কি ওর চোখেও নেমে এসেছে সহানুভূতির ছায়া, নাকি চেয়ারম্যান বাড়ির কুকুর ওসব খায় না?