চারদিকে যুদ্ধের দামামা। পাক হায়েনারা চালাচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড। টগবগে মেধাবী তরুণটি সহ্য করতে পারছেন না। চোখে মুখে শত্রু হত্যার নেশা। বাধ সাধলেন মা। ভয়ে কুকরে গেলো মায়ের মন। হাস্যউজ্জ্বল তরুণটি মাকে বললেন-‘দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়ত যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রী নিয়ে বড় ইজ্ঞিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?’। তিনি শহিদ শফি ইমাম রুমী। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে। সেই দিন জাহানারা ইমাম রুমীকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে অতন্ত্য দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন-‘ না, তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথায় মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা’।
শহিদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। যার প্রতিটি পৃষ্ঠায় আবরুদ্ধ বাংলাদেশের ছবি। আছে পাক হানাদারদের আত্যাচার, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের বিবরণ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা প্রবাহ উঠে এসেছে বইটিতে। অতন্ত্য মেধাবী রুমী সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আমেরিকার একটি ইজ্ঞিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। সেসময়ে দেশের উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রুমীকে ভাবিয়ে তুলে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তিনি। ২৫ মার্চের ভয়াল গণহত্যা রুমীর তরুণ মনে প্রখর ভাবে দাগ কাটে। অপেক্ষায় থাকে যুদ্ধে যাওয়ার। ২৫ মার্চে ধ্বংসযজ্ঞ যেভাবে বইটি এসেছে তাতে যে কারোরেই হৃদয় আতঁকে উঠবে। সেই দিন ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিলো একটি অবরুদ্ধ মৃত্যের নগরীতে।
মায়ের অনুমতি নিয়ে রুমী যুদ্ধে যায়। তার ঠিকানা ২নং সেক্টরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মেলাঘর। সেখানেই তিনি গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার সঙ্গী হয় বদি, আজাদ, জুয়েল, আলমসহ আরো অনেকেই। তাদের বাহিনীটির নাম ‘ক্র্যাক প্রাল্টুন’। তারা ঢাকা শহরে একের পর এক গেরিলা আপারেশন করে পাক হায়েনাদের অত্যাচারে জবাব দিচ্ছিল। ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারে বিচক্ষণতার গল্প বারবার গেরিলাদের মুখে শুনা যায়। তখন সমগ্রদেশে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরোদ্ধ প্রচন্ড যুদ্ধ। মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধা। লড়ে যাচ্ছে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরে গেরিলারা বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন করে। তার আগ্রভাগে ছিলো রুমী। ২৯ আগস্ট পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে এদেশীয় রাজকারদের সহায়তায় ধরা পরে বেশ কজন গেরিলা যুদ্ধা। তারমধ্যে আছে- বদি, আলম, জুয়েল, আজাদসহ আরো অনেক দামাল তরুণ। সেইদিন রুমীর সাথে বাবা শফিক ইমাম, ছোট ভাই জামীসহ তাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাক সেনারা। তাদের উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। তবু গেরিলারা ছিলো বিশ্বাসে অটল। তারা স্বীকার করতো না কোনো কিছু। সে সময়ে মায়েরা ছিলো সন্তানের পাশে, ত্যাগ স্বীকার করে উৎসাহ যোগিয়েছেন বীর সন্তানদের। যেমন শহিদ আজাদের মা তার ছেলে আজাদ কে বলছেন-‘ শক্ত হয়ে থেকো বাবা , তবু স্বীকার করো না।’ আনান্য গেরিলাদের সাথে রুমীকে রেখে বাবা ও ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হলো। শুরু হলো জাহানারা ইমামের পুত্র রুমীর জন্য অপেক্ষা। চাপা কষ্ট আর পাক হায়েনাদের অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে একদিন বিদায় নিলেন শফিক ইমাম। জাহানারা ইমাম যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তবু নুয়ে পরেননি। সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। অপেক্ষায় থেকেছেন স্বাধীন সূর্যের। ১৬ ডিসেম্বর আসলো সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়। অথচ জাহানারা ইমামের অপেক্ষা শেষ হয় না। যে ছেলে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলো সে আর আসেনি। ফিরে আসেনি বদি, আজাদ ,জুয়েলের মতো হাজার হাজার সোনার ছেলে। যাদের রক্তস্নাত উর্বর মাটিতে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।
জাহানার ইমামের একাত্তরের দিনগুলি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনের স্বাক্ষী। যার আলোময় প্রতিটি শব্দে রুমীরা জড়িয়ে আছেন; জড়িয়ে আছে হাজারো মায়ের ক্রন্দন। এরপরও শোককে শক্তিতে পরিণত করে জাহানারা ইমাম লড়ে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীর শক্তির বিপক্ষে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচাররের দাবীর আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সামনের সারিতে । হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতীক। সমগ্র দেশের জননী। সকল শহিদের জননী। জননী কি আজো রুমীদের আপেক্ষায় আছেন? সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে রুমী, আজাদ, বদিরা আছে বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনে। বীরের মতো।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালে, প্রকাশক সন্ধানী প্রকাশনী। প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী। মূল্য ২৭০ টাকা। পৃষ্ঠা ২৭০টি।