‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’
-ফিদেল কাস্ত্রো
কাস্ত্রো মহাশয়ের অমৃত বচনেই প্রমাণিত আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহিমা। কথায় আছে, ‘হাড়ির সবগুলো ভাত টিপে দেখতে হয় না।’ ফিদেল কাস্ত্রোর একটি কথাই হাড়ির একটি ভাত টিপে দেখার মতো।
যেকোনোমূল্যে ১৯৭১-সাল বাঙালি জাতির জীবনে একটি বড় ঘটনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নতুন কোন ইতিহাস হতে পারে না। ১৯৭১-সাল কি ছিল তা কেবল প্রত্যক্ষদর্শীরাই জানেন। আমি যদি একাত্তরের ভয়াবহ অবস্থার কথা বলতে যাই তাহলে ফিট্জেরাল্ডের মুখে ঝাল খেয়ে খৈয়ামকে ব্যাখ্যা করার মতো হবে। ১৯৭১-সনে কেন যুদ্ধ হয়েছিল? কি কারণে যুদ্ধ হয়েছিল? কারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? এই সকল প্রশ্নের বিশ্লেষণ করলেই এই দেশ কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে তার একটা সুরাহা করা যাবে। কোন জাতির ভবিষ্যতকে উন্নত করতে হলে দরকার সেই জাতির অতীত সম্পর্কে জানা এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া। সময়কে আমরা তিন ভাগে ভাগ করে থাকি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। এই তিন ভাগের মধ্যে অতীতকে পরির্বত করা সম্ভব নয়। বর্তমান সে তো নিজেরে রূপ নিয়েই সম্মুকে হাজির হয়েছে, এই বর্তমানকেও পরিবর্তন করা আমাদের কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হাতে বাকি ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতকে আমারা যেভাবে বিনির্মাণ করতে চাই ঠিক সেই রকম ভাবেই বিনির্মান করতে পারব। এর জন্য প্রয়োজন ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। ফরাসিরা যখন যুদ্ধে হারতে থাকে তখন এক ফরাসি লেখক ফরাসি জাতির শক্তি সঞ্চার করার জন্য ফরাসিদের ফরাসি সাহিত্য পড়তে উদ্ভূত করেন। যুদ্ধে কেন পরাজয় বরণ করল তার কারণ সাহিত্যে উল্লেখ আছে। এই সাহিত্য রচনার মধ্যেই লেখক ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারলেই বিজয় নিশ্চিত। বর্তমানে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে কি এমন কোন লেখক আছেন যার লেখা পাঠ করলে লুকায়িত শক্তির জাগরণ ঘটবে? উত্তরে পাঠিকারা কি বলেন?
অতীতের সকল ঘটনার ফলরূপে বর্তমান হাজির হয়েছে, বর্তমান ঘটনাবলির দ্বারা ভবিষ্যৎ নির্মান হবে। এটি খুবই সহজ সমীকরণ। এই সমীকরণ বুঝতে অগাধ পান্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। সাবালক হওয়ার দরকার পড়ে না, নাবালক হলেও চলে।
ইতিহাসের দিকে যদি ফিরে তাকাই, ১৯৭১-সনের আগে ১৯৪৭ সাল আমাদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ব্রিটিশ শাসনের অনূন্য দু’শ বছর কালে ভারতবর্ষ একটি অখন্ড রাষ্ট্র ছিল। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার প্রাক মূহুর্তে হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই জাতিকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করে দিয়ে যায়। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ দাবি করেছিলেন ভারতের মুসলমানরা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র জাতি। এই মুসলিম জাতির জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র বাসভূমি। জিন্নাহ্ সাহেব একসময় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন এই কথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মুসলমানরা জন্মাবধি দেখে আসছিল শিক্ষক-ডাক্তর-উকিল এমনকি প্রশাসনের প্রায় সকলেই হিন্দু। এই দৃশ্য শিক্ষায় বঞ্চিত মুসলমানদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এই ক্ষিপ্ত মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন জিন্নাহ্। কলকাতার দাঙ্গা, নোয়াখালীর দাঙ্গা, বিহারের দাঙ্গা হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমানদের ক্ষোভকে আরও ঘনীভূত করে। এর ফলে জিন্নাহর মতকে মেনে নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে পড়ে তারা। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতা দাবি করেছিলেন ভারতের সকল সম্প্রদায়ের জনগন নিয়েই একটি জাতি। তাঁদের মতে ভারতকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাগ করা উচিত হবে না। এই বচনের পরও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করা হয়। গড়ে উঠে হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল পূর্ব-পাকিস্তান এবং পশ্চিম-পাকিস্তান। পশ্চিম-পাকিস্তানিরা পূর্ব-পাকিস্তানকে কলোনি হিসাবে ব্যবহার করত। পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি পশ্চিম-পাকিস্তান। বরং এঁটেল পোকার মতো রক্ত চুষতে থাকে।
৪৭-এর পর পাকিস্তানের বাইশটি প্রধান পুঁজিপতি পরিবারের মধ্যে মাত্র একটি পরিবার ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। পূর্বাঞ্চালের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি নির্ভর। এই অঞ্চলের সস্থা কাঁচামাল এবং শ্রমের দ্বারা উপার্জিত মুনাফা দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল পশ্চিম-পাকিস্তানিরা। এরই সঙ্গে পাকিস্তানে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসত তার সবটুকুই ভোগ করত পশ্চিম-পাকিস্তানিরা। আর পূর্ব-পাকিস্তানকে এই ঋণের দায়ভার বহন করতে হত। এই সঙ্কটাপন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচী ছিল বৈষম্যমূলক অর্থব্যবস্থার স্বচ্ছ দলিল। সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগন ছয়দফাকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে নিযুক্ত করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ফলস্বরূপ পূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারণ এই সকল শোষনমূলক অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন করেছে, জীবনযুদ্ধে ঠিকে থাকার জন্য মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের আন্দোলন সংগ্রামকে প্রতিরোধ করার জন্য হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
বাঙালি জাতির রক্তে মিশে আছে বিশ্বাস ঘাতকতা। সেই ১৭৫৭-সনের পলাশি যুদ্ধের কথা স্মরণ করলেই হয়। ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকেও বিশ্বাস ঘাতকতার আলামত পরিলক্ষিত। শেক্সপিয়ার লিখছেন, সিজারকে যখন চোরা দিয়ে শেষ আঘাতটা ব্রুটাস করেছিল তখন তার মুখের কাপড়টা সরে যায়। সিজার তাকে দেখে বলেছিলেন, ‘ব্রুটাস, তুমিও’। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের কথা সকলেরই জ্ঞাত বিষয়। তদানুযায়ী ১৭৫৭-সনে মীর-জাফর ব্রুটাসের চরিত্রে ছিল। আর ১৯৭১-সনে রাজাকাররা ব্রুটাস, মীর-জাফর উভয়ের চরিত্রে ছিল। বলা চলে “একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর।” ৭১‘ সনে পাক-বাহিনীরা যা করতে পারেনি রাজাকাররা তাই করেছে। সামাজিভাবে যাদের সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল রাজাকাররা তাদের মুক্তিবাহিনী বলে হত্যা করিয়েছে। প্রকৃত মুক্তিবাহিনীর গোপন খবর প্রকাশ করেছে। একে তো পাক বাহিনী তারপর আবার সঙ্গে রাজাকার বাহিনী। এই দুয়ের হাত থেকে বাঁচা বড় দায়।
একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে সেই দেশের অর্থব্যবস্থা। অর্থব্যবস্থা দুর্বল হলে সেই দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারেনা। অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এদেশের জনসাধারণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছপা হয়নি। গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চতুস্তম্ভের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই চতুস্তম্ভকে সামনে রেখেই ৭১’ সনে আওয়ামী লীগের কর্ণধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর খলনায়কদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক নব রাষ্ট্রের। পৃথিবীর মানচিত্রে দখল করে নিয়েছে এই স্বাধীন ভূখন্ডটি। এই স্বাধীনতাই মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে। প্রমাণ করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি। এই বাংলাদেশ আমাদের সকলের। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোন সম্প্রদায়ের দেশ বাংলাদেশ নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়, “এই দেশ হিন্দু নয়, এই দেশ মুসলমানের নয়, এই দেশকে যে নিজের দেশ বলে ডাকবে, এই দেশ তার…এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার, এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।”
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সংবিধনের বিধান কি তাও আমাদের দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় চতুস্থম্ভের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা যদি স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হয় তাহলে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করা বৃথা।
স্বাধীন বাংলাদেশ শব্দটি যত সহজে মুখে উচ্চারণ করতে পারছি, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ঠিক ততটুকু বেগ পেতে হয়েছে। দিতে হয়েছে রক্ত, প্রাণ, দিতে হয়েছে মা-বোনের ইজ্জত। কথার সঙ্গে দৃশ্যগুলো যখন কল্পনার চোখে ভেসে উঠে সঙ্গে সঙ্গে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে। লিখতে গেলে কলমের কালি শুকিয়ে যায়, বলতে গেলে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীন বাংলাদেশকে যারা আজও মেনে নিতে পারেনা তারা নির্ভেজাল রাষ্ট্রদ্রোহী। যারা এই স্বাধীন বাংলার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষমূলক মনোভাবকে কটাক্ষ করে অসংস্কৃতিমূলক মনোভাবের কথা বলে দেহ তাদের মানুষের মনন তাদের পশুর। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই একটি জাতিকে সভ্য হওয়ার জন্য পথিত পাবন হিসেবে কাজ করে।
অনেক হয়েছে কথার মালা এবার নিবন্ধ শেষ করার পালা। আবদুল হাকিমের কথা দিয়েই শেষ করছি,
“যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
যারা আজ স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বাধার সৃষ্টি করে তাদের বলতে হয়, “সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”