“তোকে একটা কথা চুপিচুপি বলছি, কাউকে বলবি না কিন্তু। বীণাদি ফটিকদার প্রেমে পড়েছে।”
“কোন ফটিকদা? আমি তো একজনকেই চিনি ওই নামে রে। আমাদের আচারওয়ালা।”
“সেই!”
“বলিস কী? হলে কিন্তু খুব মজা হয় রে! বীণাদি আমাদের তাহলে এমনিতেই আচার দেবে, পয়সা লাগবে না।”
“আমাকে দিলেও দিতে পারে! তোকে, উহুঁ! কোন আশা নেই! তুই তো ভালো মেয়ে!”
“আমার পেছনে যদি এবার বীণাদির সিট্ পড়ে, ঠিক দেখাব এবার অঙ্ক! তিন সত্যি!”
বিনাপয়সায় আচার খেতে মরিয়া আমি।
“তুই বরং ওকে মিশ্রণের অঙ্ক শিখিয়ে দিস! কত গুড়ে কত আম আর কত তেঁতুল জানলে সুবিধেই হবে ওর!”
বলেই হেসে গড়িয়ে পড়ল মনোমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনের দুই ছাত্রী।
আমাদের সেই মফস্বলের ইস্কুলে মেয়েদের উচ্চাকাঙ্খা বা অ্যামবিশন বলে কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। প্রথম সারির মেয়েরা এক নম্বর দু’নম্বর বেশি পাবার জন্যে দিদিমণিদের সঙ্গে লড়াই করত, কিন্তু “তোমার জীবনের লক্ষ্য” রচনায় প্রায় সবাই ঝেঁটিয়ে লিখত “শিক্ষিকা।’ মেয়েরা ঘর সংসারের বাইরে এই একটা কাজই করতে পারে – এমন ধারণা আমাদের মনে একদম পেরেক ঠুকে ঠুকে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। তবে সে পদ পেতে গেলে ঢের পড়াশোনা করতে হয় – তাই পথটা কঠিন জানা ছিল সব্বার। তাই বেশির ভাগ মেয়েই সেই উৎসাহে জল ঢেলে ইস্কুলে আসত।
পড়াশোনাটা করতে হত বিয়ের বাজারে দর বাড়ানোর জন্যে। একটু আধটু গান শিখতেও হত। বাসরে তো অন্ততঃ লজ্জা লজ্জা করে গাইতে হবে। কেউ কেউ অতি উৎসাহী তার সাধের হারমোনিয়ামটি নিয়ে যেত শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে পুত্র কন্যা নিঃসৃত পবিত্র জলধারায় অচিরেই সেটি কাঠের উনুনে অক্ষয় স্বর্গলাভ করত।
“যতই ফার্স্ট হও, তারপরেও তো সেই রান্না করতেই হবে বাপু”, পেছনের বেঞ্চির মেয়েদের এমন সুচিন্তিত মতামত প্রায়ই কানে আসত আমাদের, যাদের জায়গা সামনের দুটি বেঞ্চে। খাতা বেরোনোর দিনে আমরা একটু বুক ফুলিয়েই ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোতে প্রবল ইচ্ছে হত পেছনের ফিসফিসানি শোনার। কিন্তু কাছে ঘেঁষলেই ওরা সতর্ক হয়ে যেত। বেশ তীক্ষ্ণসুরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কিছু কথা আমাদের কানের পর্দায় এসে সজোরে বিঁধত।
“আমাদের সঙ্গে মিশিস না ভাই, খারাপ হয়ে যাবি!”
ক্লাসে পাশে ভিড়তে না পারলেও ওদের সব খবর কিন্তু আমার কাছে আসত। পাশের পাড়ায় ভাড়া থাকত শান্তিরা। আমাদের ক্লাসেই পড়ত। পড়াশোনায় মাঝারি ছিল. কিন্তু উদ্যম ছিল লাগামছাড়া। সত্যি বলতে কী সেই উদ্যমেই পরবর্তী জীবনে অনেককিছু করেছিল শান্তি। পরিবারকে বিরাট ছাতার ছায়া দিয়েছিলো একা। সে আরেক গল্প।
আমার বাবার কাছে ছুটির দিনে পড়তে আসত শান্তি। পড়ার শেষে চুপিচুপি অনেক কথা আমাকে বলত। পেছন বেঞ্চের গোপন নিষিদ্ধ গল্প।
শরৎচন্দ্র গুলে খেয়ে ফেলা আমিটা তখন সত্যিকারের অনুপমাদের প্রেমের গল্প শুনে রোমাঞ্চিত।
“জানিস আজকাল বীণাদি দিনে তিনবার ফটিকদার আচার কেনে! দুদিন আগে ইস্কুল ছুটির পর জিজ্ঞেস করছিল চালতার আচার কী করে বানায়। ওর ঠাকুমা নাকি জানতে চেয়েছে। যত্তসব বাজে কথা।”
“কিন্তু তোরা জানলি কী করে? বীণাদি বলল?”
“এমনি এমনি কী আর বলে? আরে সবসময়ই তো ফটিকদাকে ঘিরে ভিড় থাকে। লোকের চোখ এড়ান কি এত সোজা? খালি বীণাদি ঘুর ঘুর করে ওখানে। আজ মিনতিদি চেপে ধরেছে, ব্যাস! কথা বেরিয়ে গেছে।’’
“তা কী বললো বীণাদি?”
“লজ্জা লজ্জা মুখ করল খানিকক্ষণ। তারপর কেমন গম্ভীর হয়ে বললো ফটিকদাকে না পেলে নাকি বাঁচবে না!”
“কী বলছিস? এত?”
আমার উত্তেজনায় প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। তারপরই মনে চিন্তার উদয়।
“কিন্তু ফটিকদা কি সে কথা জানে?”
“বীণাদি বলেছে ও বুঝতে পারে ফটিকদা নাকি ওকে অন্য চোখে দেখে।”
ভারি ভাবনায় পড়ে গেছিলাম। কী করে বীণাদি ফটিকদার ভাবনা টের পেল, এ গভীর প্রশ্ন মাথার ভেতরে সমানে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
শান্তির কাছেও এর জবাব ছিল না। আসলে বাইরের কারুর কাছেই বোধহয় এ জবাব থাকে না।
“তুই কিন্তু কাউকে বলবি না। তাহলে আর আমাকে বিশ্বাস করবে না।”
আমি যত রকম দেবদেবীর কথা মনে পড়ল সবার নাম দিব্যি দিয়ে একহাত জিভ কাটলাম।
ক্রমশ দেখলাম গোটা ক্লাসটাই ব্যাপারটা জানে। কিন্তু সামনে কেউ কিছু বলে না।
আস্তে আস্তে ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলো। চারদিকে গালগপ্পের অভাব ছিল না। তাই গল্পের নায়িকা হিসেবে বীণাদি একটু পিছিয়েই পড়লো।
হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা হয়ে গেলো। বীণাদির সিট্ আমার পাশে পড়ল না. তাই আমার সাহায্য করার অমন সাধও মাঠে মারা গেলো।
কিন্তু হঠাৎ জুটে গেলো বিনা পয়সার আচার!
একদিন পড়তে এসে শান্তি আমার হাতে একটা হাতলভাঙ্গা কাপ চুপিচুপি ধরাল। বাবা তখনও বাজার থেকে ফেরেননি।
“এটা চেখে বলত কেমন?”
“কে করল রে, তোর মা না ঠাকুমা?”
“বলছি পরে, আগে বল কেমন!”
আমি মুখের মধ্যে একটা তেঁতুলের দানাকে চুষতে চুষতে চোখমুখ কুঁচকেই উত্তরটা জানিয়েদিলাম। দারুণ।
“ফটিকদার আচারের মত?”
“মনে হয় তার থেকেও ভালো! উফফ মনে হচ্ছে খেয়েই যাই!”
“কে করেছে জানিস? বীণাদি। আমাদের বাড়ি এসে এক বয়াম দিয়ে গেছে।”
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। খানিকটা যেন নিশ্চিন্তও।
“কি বলছিস! উফফ আর চিন্তা নেই!”
“ওদের কেমন লাভ হবে বল। দুজনে মিলে আচার বানালে…”
আমাদের হিসেব শেষ হলো না, বাবা ফিরে এলেন।
পুজোর ছুটির পর ইস্কুল খুলল। সামনেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। এই সময় সবারই একটু পড়াশোনায় বেশি মন। এ বছরটা আরো জরুরি।
পরীক্ষার চার্ট দেবার তখন সপ্তাখানেক বাকি। হঠাৎ টিফিনের সময় দেখি লাস্ট বেঞ্চিতে বীণাদি মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে, পাশে বেশ ভিড়. সবার গম্ভীর মুখ।
আমি একফাঁকে শান্তিকে আড়ালে নিয়ে গেলাম।
“কি হয়েছে রে বীণাদির? বাড়িতে বকেছে? জেনে গেছে?”
“আজ বীণাদি ইস্কুলে ঢোকার সময় ফটিকদাকে দেখতে পায়নি। মনটা চঞ্চল ছিল, প্রতি ক্লাসেই প্রায় বেরিয়েছিল জল খেতে। টিফিনের আগের পিরিয়ডে গিয়েই তো দেখে ওই কান্ড!”
কি কান্ড সেটা আমাকে বলল না শান্তি।
“গেটে যা, গেলেই দেখতে পাবি!”
আমি পড়িমরি করে ছুটলাম।
গিয়ে দেখি ফটিকদা আচার বেচছে আর তার পাশে ঘোমটা টানা একটা বৌ পয়সার হিসেব রাখছে!
আমার সব হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। বুকের মধ্যে উঠছিল কেমন যেন একটা কষ্টের ঢেউ। সঠিক কারণটা জানা না থাকলেও স্পষ্ট বুঝছিলাম সেটা বিনা পয়সার আচার হারানোর নয়!
অদিতি ঘোষদস্তিদার -গল্পাকার, আমেরিকার নিউ জার্সিতে বসবাস। পেশায় গণিতের অধ্যাপিকা। সানন্দা, আনন্দবাজার পত্রিকাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকা বা ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখেন । নিউজার্সি থেকে প্রকাশিত অভিব্যক্তি পত্রিকার সম্পাদক।
কি দারুণ একটা গল্প। এভাবেও লেখা যায়!
আর নামকরণ? দুর্দান্ত!!