“বিষয়টি এখন প্রতিবেশীরাও জেনে গেছে,”
ড্রয়ার থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো নিয়ে বাকি সবকিছু ময়লার বাস্কেটে ফেলে দিচ্ছি আর আমার মায়ের সাথে কথা বলছি।
আমার মা এখন আর কোন কথা বলছে না। মুখ বন্ধ করে আমার সুটকেস গুছানো দেখছে কেবল। মা আর আমার মাঝখানের শূন্যতাটুকুর মধ্যখানে ধীরে ধীরে ঘন হতে থাকে একটা হিম শীতল নীরবতার চাদর। ঘরের পোষা বেড়ালটির নিঃশব্দ হাঁটার মতো মিহি পদচারণা এই নীরবতায়।
পুরোনো বইয়ের উপর জমে আছে অনেক ধুলো। আমার শীতের মোটা কাপড়গুলো থেকে কিছু তুলে নিলাম, সাথে নেবো। এলবামের পাতায় পুরোনো ছবিগুলো এতদিনে অনেকটা রুপালি হয়ে গিয়েছে, আর ছবির চারধারে ক্ষয়েও গিয়েছে বেশ। ছবিগুলো আমার বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উলের কোটটির মতো ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ। তারা এখন ফুরিয়ে যাওয়া স্মৃতির মতো বোবা। আমার মা আর বলছে না, “এই বাড়িতে তোমার জায়গা আছে। তুমি আমাদেরকে ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। তুমি আমাদের সাথেই থাকো”; আর আমিও অসম্মতি জানিয়ে বলা বন্ধ করেছি: “তুমি যা ভাবছো, ব্যাপারটা আসলে তা না।”
আমার ভাই এডওয়ার্ড আমার রুমে আসে। আমার গুছিয়ে রাখা সুটকেস দুটি ঘাড়ে করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামাচ্ছে। নামার সময় সে গুনগুন করে পুরোনো দিনের একটি গানের সুর ভাজছে। সেই গানে দিনাহর সাথে একজন বংশীবাদকের কথোপকথন হচ্ছে রান্নাঘরে। আমার ভাইটি দেখতে অবিকল আমার বাবার মতন। সেই একই রকম হাঁটা, কথা বলা, প্রাণখোলা হাসি। আর আমাদের মায়ের দিকে তাকালে তাদের দুজনেরই চোখের তারায় ফুটে উঠে সেই একই রকম উজ্জ্বল আলো। সহানুভূতি, সহমর্মিতা, মমতা। সান্ত্বনার ভাষা আছে সেই দৃষ্টিতে।
এডওয়ার্ড গাড়িতে সুটকেস তুলতে গেলে মা আমার কাছে আসে। একটি হাত রাখে আমার হাতে। মায়ের স্পর্শে আমার চামড়ার নিচে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ খেলে গেলো। মায়ের আঙ্গুলগুলো ময়দার মতো সাদা, খসখসে। আমি যেন দেখতে পেলাম, আঙুলগুলোতে নোংরা লেগে আছে এখনো। আমার ইচ্ছে করে মায়ের হাতদুটিকে সাবান দেয়া গরম পানিতে চুবিয়ে রাখি। ঐ হাতদুটি ছোটবেলায় আমাকে গোসল করিয়েছে। গোসলের সময় হাতদুটি আমার শরীরে কোথায় কোথায় যেত, আমি জানি। আমার মনে আছে সব কথা।
এডওয়ার্ড আবার আমার রুমে এসেছে। বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। এডওয়ার্ডের পায়ে আমার বাবার পুরানো বুট। বাবার জুতো পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করেছে এডওয়ার্ড। আমি তাকিয়ে থাকি জুতোজোড়ার দিকে। কয়েক বছর আগেও দেখেছি এডওয়ার্ড এই জুতো জোড়া নিজের পায়ে পরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। এখন জুতো জোড়া চমৎকারভাবে তার পায়ে লেগে গিয়েছে দেখে আমার খুব ঘৃণা লাগছে। আমার ভাইটি যখন নিঃশ্বাস ফেলে, তখন চারপাশের বাতাস কালো হয়ে যায় ওর পাপের কারণে। পচা দুর্গন্ধ ছড়ায় আশেপাশে।
ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে ফেলি আমি। আমার মনে পড়ে, নিঃশব্দ রাতের মৌনতার ভেতরে আমি হালকা কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম। গুনগুনিয়ে বিলাপ করার শব্দ ভেসে আসতো আমার কানে। মৃত্যুর আগে ক্রমাগত আমার পিতার ক্ষীণ হয়ে যাওয়া, বয়সের সাথে সাথে মনের রসালো আনন্দবোধ কমে যাওয়া; তার কয়েক বছর পর একজন বিধবা নারীর শোকপালন!
মাঝেমাঝে মনে হয়, আমি ক্ষমা করে দিতে পারি সবাইকে। সমস্ত দুর্ঘটনার যৌক্তিক ব্যাখ্যা করতে পারি। আমার সাথে করা তাদের আচরণগুলোকে তাদের দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার, ক্ষমার কথা, যুক্তির কথা, উপলব্ধির কথা – সব কিভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! সহানুভূতির সকল বোধ পিছনে পড়ে থাকে। সব পিছলে যায় আর হাততালি দেয়, বন্ধনহীন মুক্তোর মতন ক্ষমার মুক্তোরা ছুটে যায় অন্ধকারে। আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাদেরকে। তাই আমারও আর ক্ষমা করা হয়ে উঠে না কাউকেই।
আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম, তখন ওরা কেউ একটিও কথা বললো না। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, আর আমার জীবনের অনেক কথা মনে পড়তে থাকে।
আমি দৌড়ে ঘরে ফিরে যেতে চাই। আছড়ে পড়তে চাই আমার মায়ের কোলে। আমার মাথাটি রাখতে চাই মায়ের বুকে নরম বালিশের আদরে। কিন্তু সেই বুকে আমাদের দুইজনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আমি চাই, এডওয়ার্ডের প্রশস্ত হাতদুটি আমার চুলগুলিকে আগের মতো এলোমেলো করে দিক। কিন্তু আমার মনের ভেতর উস্কে উঠা নোংরা স্মৃতিগুলোকে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি বাবাকে ফিরে পেতে চাই, তবে এইভাবে এদের সাথে না। এই পরিবেশে না।
বাড়িটির দরজা থেকে গাড়ি পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আমাকে অনুসরণ করে আসে সুনসান এক নীরবতা। আমার চারপাশে কেউ নেই। যদিও অসহ্য নীরবতার অবসান ঘটলো অবশেষে। আমাকে বের করে দিয়ে বাড়ির ভেতর বন্ধ দরজার ওপাশে দু’জন অপরিচিত ব্যক্তির খুব নরম কথার শব্দ ভেসে আসে আমার কানে। আমি গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিজের কাছে নিশ্চিত হলাম, এই গৃহে আমার পরিচিত কেউ থাকে না। আমিও ছিলাম না এখানে কোনদিন।
মূলগল্প: ক্রিস্টিনা ডালচার। দক্ষিণ আমেরিকার লেখক। তিনি একাধারে একজন ভাষাবিদ, উপন্যাসিক এবং ফ্ল্যাশ ফিকশন প্রেমিক। ক্রিস্টিনা ডালচারকে কখনো দেখা যায় The Molotov Cocktail, Whiskey Paper, and New South Journal এ অন্যদের মধ্যে তার পুরষ্কার প্রাপ্ত কাজ নিয়ে। এছাড়াও তিনি লিখেছেন VOX নামে একটি বই এবং Q (Master Class in the US) নামে একটি বই রচনা করেছেন।