অখিল পাল। বাংলাদেশের অনন্য খ্যাতিমান ভাস্কর শিল্পী। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাম্প্রতিক ভাষা শহিদদের নিয়ে ভাস্কর্য ‘মোদের গরব’ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। এছাড়াও তাঁর অনান্য ভাস্কর্য গুলোর মধ্যে রয়েছে বিজয়োল্লাস, ওনুয়া স্মৃতি ভাস্কর্য, ফিরে দেখা একাত্তর, শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীনতা চত্ত্বর, অদম্য বিজয়, জ্ঞানব্রতী যতীন সরকার ইত্যাদি। অখিল পালের জন্ম ১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার লুনেশ্বর গ্রামে। ‘মোদের গরব’সহ তাঁর অন্যান্য সৃষ্টি নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলেছেন ‘চাতাল’। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেনে প্রবীর সাহা।
চাতালের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত।
অখিল পালঃ অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘মোদের গরব’ এর আগে তেমন উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য বাংলাদেশে হয়নি। ‘মোদের গরব’ তৈরির ক্ষেত্রে আপনার উৎসাহের কারণ কী?
অখিল পালঃ ‘মোদের গরব’ ভাস্কর্য যখন বাংলা একাডেমিতে স্থাপন করা হয় তখন একটা বিতর্ক ছিল। আমি বলেছিলাম- আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি বাংলা বইয়ের পাঠ্য গল্প ছিল ভাষা আন্দোলন নিয়ে। তখন রফিক, সালাম ও বরকতের গল্প ছিল। সেই গল্প পড়ে আমি প্রথম অনুপ্রানিত হই। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের বিষয়ে আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এলাকার বড় ভাইদের কাছে আরো জানতে পারি। জানতে পারি ১৯৪৮ সালে আমাদের ভাষা নিয়ে পাকিস্থানের সাথে বিবাদ তৈরি হয়।। পাকিস্তানিবা চেয়েছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু আমরা চেয়েছিলাম বাংলা ভাষা। আমাদের মাতৃভাষাকে ধরে রাখার জন্য, আমরা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। সেই থেকে আন্দোলন। ১৯৫২ সালে আন্দোলন শেষ হয়। সেই আন্দোলনে রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত শহীদ হন। এই শহীদের উদ্দেশ্যে শহীদ মিনার তৈরি হয়। আজকে আমরা যারা ২১শে ফব্রেুয়ারি পালন করি, যাদের উদ্দেশে আমরা পুস্পসবক আপন করা হলো ভাষা সৈনিক। যখন আমি পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম তখন আমি বুঝতে পেরেছি তারা আমার মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে তারা আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি মানুষের সবচেয়ে বড় সত্য হলেঅ তার নিজের মাতৃভাষঅ মানুষের নিজের মাতৃভাষঅ যদি না থাকে তাহলে তার কোন সত্য থাকে না। যারা আমাদের জন্য শহীদ হয়েছেন, আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের জন্য আমরা ভাষা ফিরে পেয়েছি। আমি যখন ৫ম শ্রেনিতে পড়ি তখন ৩০ বছর চলে গেছে। এই ৩০ বছরে কেউ তাদের নিয়ে ভাবেনি, তাদের জন্য চিন্তা করেনি- এই প্রেক্ষাপট আমাদের পিছনে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইতিহাস মনে করি। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়া পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা এবং যুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল সেটা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। বাংলাদেশে যদি কোন কিছু করার প্রয়োজন হয় ইতিহাসকে ধরার জন্য, আমাদের আগামী প্রজন্ম কিছু উপহার দেয়ার জন্য, উহাকে জাগ্রত করার জন্য মাতৃভাষাটা কি কিংবা ওরা কারা এদের বিষয়ে কিছু করা প্রয়োজন। তখন থেকেই আমার প্রতিজ্ঞা ছিল যদি কেউ ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ না করে তাহলে আমি কাজ করবো।
বাংলা একাডেমিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইমেলা হয় উপমহাদেশে যতগুলো বই মেলা হয় তার মধ্য এটি একটি অন্যতম বইমেলা। ১মাস ব্যাপি এই বইমেলা। এখানে কবিতা উৎসব হয় সারাদেশের কবিরা আসে এখানে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এখানে আসে। আমাদের ভাষাটা আন্তজাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমি ভাবলাম কাদের জন্য আমরা মাতৃভাষাটি পেয়েছি তাদের তুলে ধরলে আমাদের ইতিহাস আরো সুন্দর হয়। ভাষা শহীদদের আরো ভালভাবে বিশ্ব চিনবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
অখিল পালঃ বর্তমান প্রজন্মের কাছে মোদের গরব ভাস্কর্য কেন বা কি উদ্দেশ্যে নির্মান করা হয়েছে তার কারণ আমরা যারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ নিারে ফুল দেই সে বিষয়ে কিছু শিশু কিংবা কিছু মানুষ অজ্ঞাত রয়ে গেছে। মোদের গরব ভাস্কর্যটি শুধু একটি ভাস্কর্য নয় একটি মিনার হতে পারে। এই ভাস্কর্যটি মিনারের মতো করা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানেও সরাসরি ফুল দিতে পারে পারে। আগামী প্রজন্মের কাছে আমার কাজ যদি বিখ্যাত হয় তাহলে তাদের কাছে এই ধরনের ভাস্কর্য নির্মানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। ইতিহাস ধরে রাখার জন্য ভাস্কর্য অবশ্যই প্রয়োজন। আমরা যারা ছবি শিল্পী আছি তাদের ছবি তুলে ধরার জন্য গ্যালারি প্রয়োজন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে গণ মানুষের কাছে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ভাস্কর্য গুরুত্বপূর্ন। ভাস্কর্য হচ্ছে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে গণমানুষের কাছে তুলে ধরা যায়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য কাছ হয়েছে ফলে দেশে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সকলেই জানে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নব্বই এর আগে এত আলোচনা ছিল না। ইতিহাস মানুষকে জানানো মানুষকে জাগ্রত করাই আমার আগামী দিনের লক্ষ্য।
আপনার আরো উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিরে দেখা একাত্তর, স্বাধীনতা চত্বর, ভাস্কর্য প্রজন্ম ইত্যাদি। আপনি কোন ধরনের কাজ করতে আত্মতৃপ্তি পান?
অখিল পালঃ আমার কাজ যখন কোন স্থানে স্থাপন করা হয়, গণ মানুষ যখন সেগুলো দেখে এবং তাদের ভালো লাগে। তাদের এই ভালো লাগাটাই আমার আত্মতৃপ্তি। মানুষকে আমি কিছু দিতে পারলাম এটাই আমার তৃপ্তি।
একজন শিল্পী উদ্দেশ্য অর্থ উপাজন করা নয়। একজন শিল্পীর উদ্দেশ্য হলো ইতিহাস ধরে রাখা। একজন শিল্পী যখন কোন কাজ করে সমাজকে কিছু দিতে পারে। সমাজের মানুষের মাঝে ভালোলাগা তৈরি হয়, ইতিহাসকে ধরে রাখা যে চেষ্টা সেটাই হলো শিল্পীর আত্মতৃপ্তি।
ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাস্কর্যের ভূমিকা কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অখিল পালঃ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাস্কর্য নিরব ভূমিকা পালন করে। আসলে ভাস্কর্য কি নিয়ে কাজ করে কিংবা কোন চিন্তা চেতনার মাধ্যমে ভাস্কর্য নিমার্ণ হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে ভাস্কর্যের গুরুত্ব। অর্থাৎ শিল্পীর কাজের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে ভাস্কর্যের ভূমিকা। দেশে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নাটকের মাধ্যমে ভাষাকে বিকৃতিভাবে উপস্থাপন করে নাটক তৈরি করছে তাদের প্রতিরোধ করা উচিৎ।
আগামী দিনে আপনার পরিকল্পনা কী?
অখিল পালঃ গত দশ বছর ধরে আমি সবচেয়ে বেশি যার উপর গবেষণা করেছি সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। ১৯৫২-১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন লড়াই সংগ্রামে বঙ্গবন্ধর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২০ সাল বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সাল স্বাধীনতার ৫০ বছর সারা দেশ দেখবে। যেহেতু গত দশ বছর ধরে আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেছি তােই সরকার যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সারা দেশে ভাস্কর্য নিমার্ণের সিন্ধান্ত নেয় এবয় আমাকে সেই কাজে যুক্ত করেন তাহরে আমি সেই কাজ করবো। জীবনে আমি অনেক কিছুই করেছি। ভাস্কর্য শিল্পের কাজ বাদ দিয়ে অন্যকিছু আমার ভালো লাগে না। আমার টাকার হিসেব করতে ভালো লাগে না ভালো লাগে কাজ করতে। ইতিহাসে আমাদের দেশে অনেক গুণী মানুষ ছিল। তাদের আজও সামনে আনা হয়নি। ২০০৭-০৮ সালের দিকে আমারা একটি পরিকল্পনা করেছিলাম। ঢাকা শহরে যত গলি আছে প্রত্যেকটির একটি নাম আছে। প্রতিটি রোডের নাম আমরা জানি না। এইসব রোডের মাথায় একটি ভাস্কর্য থাকতো তাহলে সকলেই জানতো তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং দেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়তো, দেশের প্রতি টান থাকতো। আমাদের দেশের যারা বড় বড় ব্যক্তিত্ব ছিল তাদের প্রত্যেকের ভাস্কর্য তৈরি হওয়া উচিৎ।
আপনার কাজ করতে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পরতে হয়?
অখিল পালঃ ভাস্কর্য তৈরি প্রথম বাধা হচ্ছে একটি কমিটি হয়। আপনাকে নির্বাচন করা হলো। ধরেন পাঁচ জনকে নেয়া হলো। সময় যত দীর্ঘ হয় এর মধ্যে প্রতিবাদ তৈরি হতে থাকে। বলা হয় এটা মুর্তি এটা বানানো যাবে না- এটা সমস্যা। ধর্মীয় ইস্যু এনে কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশে ভাস্কর্য নির্মানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এটিই। অথচ ধর্মের কোথাও লেখা নেই ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে। অর্থাৎ কমিটি যত দীর্ঘায়িত করে ভাস্কর্য নির্মাণে প্রতিকন্ধকতা যত বাড়তে থাকে।
আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেয়ার জন্য।
অখিল পালঃ চাতাল অন লাইন পত্রিকা যা ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চালু হতে যাচ্ছে এটা আনন্দের খবর। আমাকে প্রথম সংখ্যায় শিল্পী হিসেবে আমার স্বাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। চাতাল সারা দেশে আলোরণ সৃষ্টি করবে সেই প্রত্যাশা করছি।
ভাস্কর অখিল পাল