“কথায় আছে শেষ বসন্তের এমন বাতাসের সান্ধ্য সংস্করণ নাকি বড় সর্বনেশে” – এটা আমার কথা নয়, লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস বসন্তের হাওয়ায় নাকি একটা কেমন যেন ব্য়াপার আছে, যা সম্পর্কের সব সমীকরণ গুলিয়ে দেয়।
মিশি কালো অন্ধকারের বুক চিড়ে বর্ধমান রোডের ওপর দিয়ে তীখ্ন হেড লাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলেছে একটার পর একটা গাড়ি, তার মধ্য়েই কলকাতা ছেড়ে যাওয়া দুটো গাড়ির সওয়ারিরা চলেছেন অজান্তে এক নতুন কাহিনী গড়ে তুলতে -এদের কেউ নিছক ছুটি কাটাতে, আবার কেউ পেশাদারিত্বের গূট দায়িত্ব কাঁধে—গন্তব্য় শান্তিনিকেতন, বোলপুর। একটি গাড়ির সওয়ারি টিভি সাংবাদিক ঋতৃণ ভট্টাচার্য, অন্য় গাড়ির সওয়ারি অগ্নি-সুস্মিতা, মোহনা-অরণী-ঔপন্য়াসিক ঋতব্রত ভট্টাচার্যের উপন্য়াস “বসন্ত ফিরে আসে” তে এই চরিত্রগুলোর জীবনের চেনা গন্ডি ছেড়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার কাহিনীকে সযত্নে ও নিখুঁত শব্দচয়নের দ্বারা সূখ্মতম অনুভূতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কাহিনীর শুরু সাংবাদিক ঋতৃণ ভট্টাচার্যের হাত ধরে, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ আর ব্রেকিং নিউজের চক্করে ক্লান্ত শরীর, কিন্তু পেশাদারিত্বের নিষ্ঠতাকে সঙ্গী করে ঋতৃণ এখন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে- বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে চ্য়ানেলে লাইভ করতে হবে। তাই আগের রাতে কলকাতা ছেড়ে শক্তিগড় হয়ে তাঁর গাড়ি বোলপুরের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। তাঁর চ্যানেল বসন্ত উৎসবের তিনদিনের এক্সক্লুসিভ রাইটস কিনে নিয়েছে, তাই কোনরকম অজুহাত চলবে না। গাড়ির চাকা যত বোলপুরের নিকট হচ্ছে ঋতৃণের চিন্তাও একটু করে গভীর হচ্ছে। অন্য গাড়িতে অগ্নি-মোহনার সম্পর্কের রসায়ণকে ফুটিয়ে তুলতে লেখক একরত্তি সুস্নাতর আবদারকে বড় প্রশ্রয় দিয়েছে।
জোছনা ভরা রাতে ফুরফরে ঠান্ডা হাওয়ায় গাড়ির চালক, অরণী, সুস্মিতার অলখ্যে অগ্নি-মোহনার একান্ত আপাত লাগামহীন সম্পর্কের জগতকে লেখক নিখুঁত শব্দ চয়নে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঋতব্রত’র উপন্য়াসে মোহনা অরণীর স্ত্রী, অগ্নি সুস্মিতার স্বামী। পেশার জগতে অগ্নি-মোহনার পরিচয়, ফলে মোহনার সঙ্গে আর যে অগ্নির বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় নেয়নি। রাজনৈতিক পটভূমি বদলের চাপানউতোর কখন যে অগ্নি-মোহনাকে পেশার জগতের লড়াইয়ে এক সুঁতোয় বেঁধে দিয়েছিল, কেউ টের পায়নি – লেখকের কলমের ছোঁয়ায় দুটো হৃদয় এক হয়ে গেছে, সময়ের সঙ্গে গভীরতাও বেড়েছে। তাই লেখক উপন্যাসের সিংহভাগ জায়গায় নিখুঁত শব্দ প্রয়োগের দ্বারা অগ্নি-মোহনাকে অনেকটা সাবধানী করে তুলেছেন। অগ্নি-মোহনার পাপহীন প্রেম যে একেবারেই অবাস্তব নয়, কাহিনীর বাঁকে প্রতি মুহুর্তে ধরা পড়েছে। তথাকথিত ভিন্ন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নরনারী আমাদের বাস্তব জীবনেও কখনো না কখনো বেরিয়ে পড়েন নতুন করে বেঁচে থাকার সন্ধানে।
এদিকে, শান্তিনিকেতনেও ঋতৃণের জন্যও এমনকিছু অপেক্ষা করেছিল, যার আঁচটুকুও কল্পনাতীত ছিল। অদৃষ্টের লেখন খন্ডাবে এমন ধৃষ্ঠতা করবে কে—তাই পলাশ ফুলের মালা কিনতে গিয়ে চ্যানেলের তারকা সাংবাদিক ঋতৃণকে খানিকটা বেসামাল হতে হয়েছিল। বিশ্বভারতীর ছাত্রী শুভশ্রীর তীখন প্রশ্নের মুখে ‘টাকা দিলেই সব নেওয়া যায় বুঝি?” প্রথম দেখায় কিছু তো হল, কিন্তু কি হল তা কেউই বুঝল না। চ্যানেলের লাইভ প্রোগ্রামের পর চেনা ছন্দে এগিয়েছে ঋতৃণ শুভশ্রীর কাহিনী এগিয়েছে। কখনও সংগীত ভবনের পাশে মোরামের রাস্তায়, কখনও রঞ্জনদার ক্য়ান্টিনে, কালো বাড়ির বারান্দায় শুভশ্রী ও ঋতৃণের কারুরই খুব একটা আপত্তি নেই পাশাপাশি বসে থাকতে।
কাহিনীর চরিত্রগুলোকে নির্দিষ্ট পরিসরে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি কালো বাড়ি ও তার ইতিহাস, রবীন্দ্র চিন্তনে গড়ে ওঠা বিশ্বভারতীর যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, এককথায় অনবদ্য়। এতকিছুর মধ্য়েও একজন সাংবাদিক তাঁর দায়িত্বের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ প্রতিমুহুর্তে নিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বসন্ত কি শুধু ওদের মনেই ধরা দিয়েছে,মোহময়ী বাতাসের স্পর্শে মোহনা রাধার মতো ছুতো খুঁজে বারবার অগ্নিকে ধরা দিয়েছে। কাহিনীতে অগ্নি সমাজের তোয়াক্কা না করে মোহনার সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ককে প্রকাশ্য়ে নিয়ে আসে। অগ্নি-মোহনার সম্পর্ক নতুন রূপ পেল, কিন্তু ঋতৃণ শুভশ্রীর জন্য় কবির কথায় বলা যায় – “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।” বইটি প্রকাশ করেছে প্রিয়শিল্প প্রকাশন, কলকাতা।