একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলন। বাঙালি জাতিসত্তার এক অনন্য অধ্যায়। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এই ভিত আর চিন্তায়ই প্রতিষ্ঠিত। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো মাধ্যমই নেই যার উপর একুশে ফেব্রুয়ারি,একুশের চেতনার প্রভাব পড়েনি। আজ ভাষা অধিকার অর্জনের সত্তর বছর অতিবাহিত হবার পরও আসাও মহিমায় সেই বোধ উজ্জ্বল হয়ে আছে। কবিতা-নাটক-উপন্যাস-চলচ্চিত্র সবকিছুতেই এক অনিবার্য অধ্যায় এই ভাষা আন্দোলন। নতুন শতাব্দীর দুইটি দশক অতিক্রান্ত হবার পরও এইদেশের সাহিত্যবাসরে চিরভাস্বর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই দিন, সেই অধ্যয়।
একুশে নিয়ে অসংখ্য কবিতা রচিত হয়েছে বাংলাদেশে। এখনো হচ্ছে। ভাষার প্রতি এই দরদী অনুভব সর্বজন বিদিত। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আদিগ্রন্থ চর্যাপদ আবিষ্কার থেকে শুরু করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে প্রাণ দেয়া পর্যন্ত বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করে তোলা ছিলো একটি অধিকার, সময়ের সাহসী দাবী। সে দাবী আদায়ের পরও থেমে থাকেননি বাংলাভাষা গবেষকগণ। তাদের পর্যালোচনা, ইতিহাস-বিশ্লেষণ, বিশ্ববাসীর নিকট উপস্থাপন। সব মিলিয়েই আজকের বিশ্বে বাংলাভাষার স্বতন্ত্র অবস্থান। একুশের চেতনা আমাদের জাতিসত্তার সুদীর্ঘ ইতিহাস ধারণ করে আছে।এই ইতিহাস রচিত হয়েছে অক্ষরে অক্ষরে… কাগজে-কলমে। এ চেতনা বাঙালি জাতিসত্তার আদর্শ এবং উন্মুক্ত বৈভবের শিরস্ত্রাণ। এ দেশের, সমাজের আর আধুনিক সমাজচিন্তা বিনির্মাণের এক আশ্চর্য মঞ্চ একুশে ফেব্রুয়ারি। আলোকোজ্জ্বল এক প্রত্যাশার পথ নির্মাণে বারবার বাঁধা পেয়েছে এই আদর্শ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্বীকৃতি পেলেও সর্বস্তরে বাংলাভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি।এই বিষয়টি যতোটা যন্ত্রণা দেয় তারো চেয়ে অধিক যন্ত্রণা দেয় বাংলাভাষার অপব্যবহার। এই অপব্যবহার একজন সচেতন বাঙালির অন্তরাত্মাকে পরিচালিত করে এক অবিশ্বাস্য শুন্যতার দিকে। তাড়িত করে একজন কবির মগজের অনিবার্য স্ফুরণকে। ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে আর কেউ ব্যথিত হোক বা না হোক বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং স্পর্শকাতর লেখকরাই সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হন। তাদের চিন্তা তাদের ধ্যান আর তাদের প্রায়োগিক জীবনাচারের ভেতর ভাষার এক অনন্য সৌন্দর্য লেপ্টে থাকে দারুন রূপে। এই বিষয়টি সবাই বুঝতে না পারলেও একজন সৃজনশীল লেখক এবং একজন সামাজিক দায়বদ্ধ লেখক মাত্রই একটি রাষ্ট্রের ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকেন। এই অবগত থাকাটাই যে বস্তুত ভাষার প্রতি চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ শুধু তাই নয় সেই সাথে ভাষার প্রতি চরম শ্রদ্ধাশীল থাকাটাও একজন লেখক তার দায়িত্ব এবং কর্তব্য মনে করেন। এইসব ভাবনার পরেও লেখক যখন দেখতে পান ভাষা আক্রান্ত হচ্ছে বিদেশী সংস্কৃতি দ্বারা, তিনি যখন বুঝতে পারেন এই আক্রান্ত সংস্কৃতিকে একা হাতে মোকাবেলা করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে ঠিক তখন কখনো কখনো লেখক তার হতাশা, আত্মগ্লানির কাছে দমিত হতে থাকেন। অনন্ত কবিতার ভাষা তো তাই সাক্ষ্য দেয়–
১.
উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা/ শামসুর রাহমান)
২.
রামনিধি গুপ্ত মহাশয়,
কে বলেছে আপনাকে, বিনা স্বদেশী ভাষা আশা পুরে না? আমরা আশার গুড়ে এমন বালি মিশিয়েছি যে সে গুড় দিয়ে মা দাদীদের হাতের ক্ষীর বা পায়েস হয় না। তবে ডেজার্টটা বেশ ভালোই হয়। ডোন্ট ওরি!
আমাদের মাতৃভাষা আজ বিদেশি সাপের বিষাক্ত দংশনে নীল হয়ে আছে। একদম ভাববেন না! আমরা বিজাতীয় ভেলায় তাকে ভাসিয়ে দেবার যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। লেটস সেলিব্রেট!!!
(আমাদের কোন সর্বনাশ হয়নি /নাহিদা আশরাফী)
সময় সভ্যতা আর পারিপার্শ্বিক বিবর্তনের সাথে সাথে যেমন পরিবর্তন হয় মানুষের চিন্তা-চেতনা তেমনি বিবর্তন ঘটে ভাষা ও সাহিত্যে। সেই স্রোতের ধারাবাহিকতায় একুশের চেতনাকে ভিন্ন চোখে দেখছেন অনেকেই। তাদের লেখায়, চিন্তায় একুশের চেতনার পক্ষে হাহাকার জেগে ওঠেছে বারবার।তবে সময় চিন্তার দূরত্বে আর দৌরাত্ম্যে একুশে নিয়ে অনেকেরই চেতনায় দুঃখবোধের বিশাল ব্যবধান চোখে পড়ে বর্তমান কবিদের চিন্তাধারায়। প্রাজন্মিক দৃষ্টি এবং সংস্কৃতি থেকে একুশের চেতনার অবক্ষয়তাকে চিহ্ণিত করেছেন তাদের কবিতায়-
পতাকার সবুজ জমিন আজ বিবর্ণ ধূসর প্রায়
ম্লান ম্রিয়মাণ–
একুশের সোনামুখী চুলে আজ পৌঢ়ত্বের ছায়া।
দেশজুড়ে সন্ত্রাসের মহোৎসব দেখে
মনে হয়–
ধ্বংস যেন যে․বনের অনিবার্য ক্রীড়া
অন্ধকার আজ বড় জনপ্রিয় ছবি
আদিমতা আমাদের রক্তজ প্রেরণা।
( প্রেরণা / তপন বাগচী )
বাঙালি জাতিসত্তার আবেগ-উচ্ছ্বাস ভালোবাসা,সুখ সবকিছু ঘিরে রেখেছে একুশের চেতনা। এদেশের ধূলিকণা, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি অক্ষরে সুরে একুশের অনিঃশেষ আঁচড় পরিলক্ষিত হয়। একেবারেই সহজ ভাষায় বলা যায়, বাংলাদেশের মানচিত্র আবহাওয়া বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-হাসি-কান্না সবকিছুতেই একুশের চেতনা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। আবার পাশাপাশি রয়েছে এই একুশের চেতনার অপব্যবহার অর্থাৎ ভাষার অপপ্রয়োগ। পশ্চিমা সাহিত্য-সংস্কৃতি এদেশে একচ্ছত্র প্রভাব না ফেললেও অনেকাংশেই বাঙালি জাতিসত্তাকে নিজস্ব শৈলীতে প্রকাশিত হতে ব্যাহত করেছে। ভালোবাসার অনন্য শিরোনাম একুশের চেতনা আজ অনেক ক্ষেত্রেই কেবল প্রথাবদ্ধ সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে,এই মন্তব্য অপ্রিয় হলেও নির্জলা সত্য।
এসব অনুভূতি নিয়েই তৈরি হচ্ছে বর্তমান সময়ের সাহিত্য।কবিতা-গান এবং শব্দের দ্যোতনায় চিরায়িত সেই সুর কিছুটা ম্লান হলেও এদেশের অনেক কবির কবিতায় একুশে উঠে এসেছে স্বংয়ম্ভু সাহসে–
হাওয়া কি তোলপাড়! কৃষ্ণচূড়ায় রক্তিম দিন;
আসবে আসবে করেও মিছিলে আটকে আছে পা
শুনেছি এ-বছর অক্ষরের বৃষ্টি হবে খুব-
লাউয়ের ফুলগুলো তাই এত রঙিন!
রক্ত ছাড়া নেবে কী আর-বলেছিলো: রফিক-শফিক
আমাদের অহঙ্কার সসম্ভ্রমে গেঁথে দিয়ে মায়ের মুখে;
অবশেষে তুমি এলে, অচেনা এক মর্মর জয় করে
ইট-তৃণ আর কংক্রিটে ভেসে ওঠা রক্তচন্দন!
(রক্তচন্দনের মর্মর /বীরেন মুখার্জী)
আমাদের জাতীয় চেতনায় এক বিশাল অংশ জুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি রয়েছে। আমাদের ভালোলাগা ভালোবাসা আমাদের যাপিত জীবনের সমস্ত বিদ্রোহ ক্রোধ আরো কিছু মিলে যে বিশাল এক অমিও ভাণ্ড তৈরি হয়েছে তার মূলেই একুশের চেতনা। ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মায়ের ভাষা প্রকাশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি বাংলা ভাষার মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে সেটি যেমন সত্য তেমনি সত্য বিশ্ব বাসি ধন্য হয়েছে বাংলা ভাষার মতো এমন একটি প্রাচুর্যপূর্ণ ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পেরে। স্বভাবতই এরকম একটি মহান অর্জনের একই সাথে অনিচ্ছুক ও কিঞ্চিৎ অপপ্রয়োগ জনসাধারণ সহশিল্পী কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী প্রমূখ সমাজকে ব্যথিত করে। এই ব্যথিত হৃদয় থেকেই তৈরি হচ্ছে ভিন্নধারার অনুচেতনা যা বাংলা ভাষার মর্যাদাকে বিশ্ববাসীর কাছে কিছুটা অন্য ভাবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে হয়ত ইদানিং।
একুশের শুদ্ধচেতনা হয়ে উঠুক আমাদের আজন্ম সাহস এবং গৌরবের অনিবার্য প্রতীক।