এক
‘দিদি, ওই লোকরে আর ঘরে উঠামু না!’ ঘুম চোখে সকাল সকাল এরকম কোনো কথার মানেই প্রথম বুঝতে পারছিলাম। মাত্র বিছানা ছেড়ে উঠেছি। আমার ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে আসে সহকারী আফরোজা। এক মেয়ে আর এক ছেলের মা আফরোজার বাড়ি নীলফামারীতে। মগবাজার নয়াটোলার কোনো এক বস্তিতে থাকে ছেলে আর স্বামীকে সাথে নিয়ে। মেয়ে গ্রামের বাড়িতে নানা-নানীর কাছে থাকে। বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন নানা-নানী। ছেলেটা একটা গার্মেন্টেসে কাজ করে শ্রমিক হিসেবে। ওই গার্মেন্টেসেরই একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে। বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে কিছুতেই ছেলের বিয়ে করাতে নারাজ আফরোজা। স্বামী রতন মাঝে মাঝে মন চাইলে রিক্সা চালায়। না চাইলে ঘরে বসে থাকে। এসব গল্পই টুক টুক করে কাজের ফাঁকে ফাঁকে। আমি রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে খুঁটিনাটি শুনে মজাই পাই। নগরজীবনে আফরোজা যে কখন পরমাত্মীয় হয়ে গেছে বুঝতেই পারি না। কয়েকদিন থেকে সকাল বেলায় এসাইনমেন্ট থাকায় ভোর ভোর বাসা থেকে বের হচ্ছি তার সাথে দেখা হচ্ছে না। ঘরের চাবি এক জায়গায় রেখে দিয়ে যাই নিজের সময়মতো সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে যায় নিয়মমাফিক। এই ক’দিন পরে আজকেই একটু সময় পেয়ে আয়েশ করে চা বানাতে যাচ্ছিলাম এই সময় তার মুখে এমন বাক্যে কিছুটা ‘থ’ মেরেই গেলাম! আবার জিজ্ঞেস করি ‘কাকে ঘরে তুলবে না?’ হুট করে গলার ওড়নাটা নামিয়ে বলে, এই দেখেন মেরে কি করছে? সারা শরীরে দাগ বসাইয়া দিছে?’ একটু হতচকিত হয়ে গেলাম! সে বলতে থাকলো, মোবাইলে একটা অপরিচিত নম্বর থেইক্কা ফোন আসছে দেইক্কা আমারে এইরকম মাইরধোর করছে। সব টাকা-পয়সা নিয়া দুই দিন ধইরা কই চইলা গেছে। এর আগেও এরকম করছে অনেকবার। তাই এইবার সিদ্ধান্ত নিছি আর তারে ঘরে তুলবো না!’ আফরোজার দৃঢ়তার কাছে মাথা নত হলো আমার। বললাম, ‘তুমি যা ভালো মনে করো করবে। যদি কোনো দরকার হয় অবশ্যই আমাকে বলবে।’ আফরোজার সাফ উত্তর, ‘দিদি আমারে একটা উকিল ধরে দিনু, হেই বেটারে আমি তালাক দিমু!’
দুই
ঘড়িতে রাত আড়াইটা বাজে। ফেসবুকের ম্যাসাঞ্জারে একের পর এক ফোন। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ খোলে রাখা দায়। কিন্তু এত রাতে খুব জরুরি কোনো দরকার না হলে নিশ্চয়ই ফোন করে নি তিতলি’র মা। আমার খুব প্রিয় একজন বৌদি। যান্ত্রিক এই শহরে যে দুই একজনের সঙ্গে কথা বলে স্বস্তি পাই তাদের মধ্যে এই বৌদি একজন। প্রায় সময়ই নিজের নানান বিষয়ে আমার পরামর্শই নাকি তার সবচেয়ে পছন্দের। আধাপাগলা টাইপের স্বামীকে নিয়ে আক্ষেপেরে শেষ নেই। বৌদির ভাষায়, ‘যত টাকা রোজগার করে তার বেশিরভাগই বাইরের মেয়েদের পিছনে খরচ করে ফেলে। বাচ্চাদের জন্য এটা-সেটা কিনে আনলেও জীবনে তার জন্য একগাছা চুড়িও কিনে আনে নি কখনো। প্রতি মাসে বাসা ভাড়াটা দিতে নাভিশ্বাস উঠে যায় বৌদির। মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে গায়ে হাত তোলাও নাকি বাদ দেয় না।’ কিন্তু আজকের ঘটনাটা খুবই বেশি রকমের বাড়াবাড়ি বলেই হয়তো এত রাতে আমাকে ফোন দিচ্ছে। রিসিভ করতেই ফোনের ওপার থেকে হাউমাউ করে কান্না। ‘তুমি আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেলবে না হয়। রাত বারোটার দিকে একটা মেয়েকে নিয়ে বাসায় এসেছে তোমার ভাই। আজ নাকি সেই মেয়ে আমাদের বাসায় থাকবে। ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা আছে তাদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়বে এই বলে যেই প্রতিবাদ করতে গিয়েই শুরু হয়েছে তার খারাপ ব্যবহার। চিৎকার-চেচামেচির পর এবার শুরু করেছে মার-ধোর। কোনোমতে বেডরুমে এসে দরজা লক করে তোমাকে ফোন দিয়েছি। প্লিজ আমাকে উদ্ধার করো এই বিপদ থেকে।’ হাত পা হিম হয়ে আসছিলো কথাগুলো শুনে। আমি পুলিশের ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিলাম বৌদি এবং তার ছেলে মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য। পুলিশ যথারীতি তাদের কর্তব্য পালন করার পাশাপাশি আটক করলো সেই মেয়ে এবং দাদাকেও। বৌদি আর একদিনের জন্যও দাদার কথা বলে নি আমাকে। যদিও হিন্দু বিবাহ আইনে বিচ্ছেদের কোনো সুযোগ নেই তারপরও সে নিজের মতো করে সাজিয়েছে জীবন আবার। ছোট একটা বেসরকারি অফিসে নিয়েছে চাকরি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে করেছে যাচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রামটা একাই।
তিন
প্রায় একই রকম গল্প হলেও ঈশিতা (ছদ্মনাম) আপার স্বামীর নারীঘটিত কোনো দুর্বলতা ছিলো বলে কখনোই শুনি নি। তার একটাই সমস্যা সে কোনো কাজ করবে না। কারো অধীনে চাকরি করবে না। বিয়ের পর থেকে আজ প্রায় ১৫ বছর যাবত চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর। কিন্তু বছরের পর বছর অবস্থা একই। কোনো কোনো মাসে ১ টাকাও তুলে দিতে পারে না স্ত্রীর হাতে সংসার চালানোর জন্য। ভাগ্যিস এনজিও’র চাকরিটা ছিলো। তাই মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার লড়াইটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে স্বামীর অদ্ভুত খেয়ালের কাছে অসহায় পড়েছেন আপা। ব্যবসার নাম করে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাচ্ছেন কয়েকদিনের জন্য। কোনো যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে কি না তাও জানতে পারার উপায় নেই। একদিন মেয়েকে নিয়ে বের হবে বলে সেই যে সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়েছিলো তারপর প্রায় এক মাস পর ঘরে ফিরলো আজ। অনেক হয়েছে আর না! কাছে থেকেও যে সাথে থাকে না তাকে নিয়ে আর সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কোনো মানে নেই। উকিলের সাথে কথা বলে বিবাহবিচ্ছেদের সব ব্যবস্থা করে ধরিয়ে দিলো স্বামীর হাতে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত একলা হাতেই মেয়েকে নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন ঈশিতা আপা।
বেগম রোকেয়া যে নারী জাগরণের মূলমন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলার নারীদের মধ্যে আজ যেনো তা জাগতে শুরু করেছে। উপরের গল্পগুলো একেবারেই সত্যি। এরকম হাজারো নারী প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যুদ্ধ করে যাচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, সমাজে প্রতিদিন এরকম নারীদের সংখ্যাই বাড়ছে। জনপ্রিয় একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ‘ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধলাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। এ হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬টি, দিনে ২৪টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটেসটিকস’-এর তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে।
সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গ্রামীণ হতদরিদ্র পরিবারে তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীর সংখ্যাও বাড়ছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ শিরোনামে একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। শুরুতে এ ধরনের ৪ লাখ ৩ হাজার ১১০ জন নারীকে মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ। দরিদ্র পরিবারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তালাকের পর অথবা স্বামী মারা গেলে ওই নারী তার নিজের পরিবার থেকেও তেমন একটা সহায়তা পান না। তবে এখন সময় বদলে গেছে। উন্নত হয়েছে জীবন যাত্রার মান। উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। আর এর বেশিরভাগ অবদানই নারীদেরই। তাই এখন আর তাদের কারও মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। নিজের যুদ্ধটা নিজেই স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নিয়ে গর্বিত জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত ললনারা। নারী দিবসের প্রাক্কালে সম্মান এরকম সব সংগ্রামী নারীদেরই প্রাপ্য। ভবিষ্যতের আলোর প্রদীপটা যে তাদের হাতেই।