বাবার স্বপ্ন
(দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা পিতাকে)
আমার বাবার মুখে বাবার সেই মুখ দেখতে পাই না এ্যাখন
পলিমাটির স্নিগ্ধ উজ্জ্বল কৃষিরঙে আঁকা মায়াময় সে শ্যামলে
বদলে যাওয়া স্বপ্ন্ঋতুর নির্যাতন চিহ্ন দেখি !
জলরঙে আঁকা মানবতার উদ্যানে
ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের অক্ষম হাহাকার দেখি
দীর্ঘশ্বাসের ভাঁজ খুলে তার শুধু স্বপ্ন পোড়া গন্ধ পাই
জীবনের ভাঁজ খুলে তার শুধু জীবন পোড়া গন্ধ পাই
বাবাকে প্রতিদিন দৃশ্যের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখি
বাবার চোখে স্বপ্ন ছিলো
ভূগোলের ম্যাপ থেকে উঠে যাবে একদিন সীমান্তরেখা
মুক্ত নিসর্গে হাত ধরে হেঁটে যাবে জীবন জীবনের সাথে
শান্তি-সৌহার্দ্যরে মানবিক বাতাসে
বেড়ে উঠবে মেধাবী সন্তান তাঁর,
পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তরকাল
তারই গৌরব সৌরভ ছড়াবে
উজ্জ্বল মুখ,উচ্ছল বুকে বেঁচে থাকবেন তিনি
নক্ষত্র’র আলোয় ,নক্ষত্র’র জন্মদাতা ।
তার বুকের ভেতর নিঃসঙ্গ স্বপ্নসমুদ্রের বিদীর্ণ গভীরতা দেখতে পাই আমি
লীলাবতী সে মোহরঙ মোহনায় এসে বর্ণিল আগুনের মরুভূমি হয়ে যায় !
বাবা স্বপ্ন দ্যাখেন ,লাল স্বপ্ন নীল স্বপ্ন হরিৎ-ঐশ্বর্য বিমূর্ত স্বপ্ন
স্বপ্নগুলো সূর্যভূক ঘোড়া হয়ে ছুটে যায় আলেয়ার প্রান্তরে
বাবা তবু স্বপ্ন দ্যখেন-
ফুলের বাগান থেকে দুঃস্বপ্নের সাপ তাড়াতে তাড়াতে স্বপ্ন দ্যখেন,
বিপ্লবী অশ্বারোহী সন্তান তার এসেছে ফিরে পিতৃভূমির দাবিতে
হাতে তার সুলেমানী তরবারি ।
উদয়াস্ত সমান সোনালিখোয়াব বুকে পুষে মৌনবৃক্ষ হৃদয়ে
হৃদয়ান্ধ বাবা আমার দ্বাবিংশ শতাব্দীর আকাশে খোঁজেন সবুজ নিঃশ্বাস
ঘর থেকে জানালায় চোখ রেখে খুঁজে ফেরেন
আকাশের পরিসীমায় জীবনের আয়তন ।
তার বিশ্বাসের উৎস ভূমি নিচু হতে হতে
ক্রমেই হয়ে যায় রঙিন গর্তের সুড়ঙ্গপথ !
বাবা, আমি তোমার গহীন গহনে নিসর্গ পোড়া গন্ধ পাই,
সন্ত আত্মার সুফলা বীজগুলোকে আগুনের আঙিনায়
ভোরের শিশিরের মতো ঝরে যেতে দেখি !
মনে পড়ে-
মুক্তির মিছিলের মতোই সাহসী ছিলে তুমি
এভারেস্ট চুড়ার উন্নত শিরে পরেছিলে ব্যক্তিত্বের মুকুট
শত সংঘাত বুকে বয়েও ভিড়াও নাও জাহাজ বাণিজ্যতীরে
সময়ের প্রলোভোন ফিরে গেছে বারবার পরাজিত বিবেকে ।
বাবা .আমি তোমার স্বপ্ন-সংগ্রাম দিনের কথা বলছি
সৃষ্টি উল্লাস পুষ্পফলা কালের কথা বলছি
তুমি বলতে,আমি শিক্ষক আদি পুরোহিত দ্বিতীয় জীবন পিতা
শাশ্বত প্রেম আমি,জীবন চেতনা বিকাশ ধারার ।
স্কুলের সবুজ মাঠের আলপথে যেতে যেতে
আকাশে পাখির ঝাঁক উড়ে যাওয়া
ধানের ক্ষেতে কৃষকের সোনালি হাসি
নদীতে মাছের অবাধ সাঁতার দেখে,স্বাধীনতা-স্বাধীনতা
সঙ্গীত ধ্বনীতে নেচে উঠতে ধমনীময়,
কিশোরী সবুজ ধানের ছড়া বুকে জড়িয়ে
পরম স্নেহে বলতে,বল খোকা,জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী;
বিস্ময় চোখে আমি তাকিয়ে থাকতাম !
তুমি বিপ্লব ,চেতনা জয়ের কথা বলতে
বোধিবৃক্ষের মৌনতার কথা বলতে
বলতে, জানিস খোকা ,আসলে মানুষের কোনো সৌন্দর্য নাই
সৌন্দর্য তার আত্মা,মানুষ তার আত্মার সৌন্দর্য রূপ ধারণ করে …
তোমার কণ্ঠে সেদিন জীবন উচ্চারিত ছিলো
বাক্যে প্রেম-প্রেরণা উজ্জীবিত ছিলো
গভীরতায় অভিজ্ঞতা বর্ণিত ছিলো ।
তুমি বলতে,পা পথের আড়াআড়ি পথ আছে খোকা
জীবন পথের কোনো আড়াআড়ি পথ নাই
জীবন সংগ্রামী না হলে মানুষ ব্যাধি হয়ে বাঁচে ।
মানবতা, প্রেম শেখাতে চেনাতে তুমি
মাদার তেরেসার হৃদয় আশ্রম ,
সংগ্রাম শেখাতে শোনাতে নেতাজীর জীবন
শান্তি বোঝাতে শেখাতে মহাত্মার অহিংস আন্দোলন
স্বাধীনতা বোঝাতে শোনাতে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর
জীবনের প্রেরণা ছিলো তোমার রবীন্দ্রনাথ ।
বিপন্নঋতুর আগুনডানায় স্বপ্নজাল চোখে
তুমি কখনো মাষ্টারদা,কখনো প্রীতিলতার কণ্ঠ হয়ে যেতে,
নজরুলের কবিতা বিদ্রোহে চেতনার প্রদীপ জ্বালাতে অন্তরে।
তোমার ভেতর তখোন অরণ্য ছিলো ,সমুদ্র ছিলো ছিলো অসীম আকাশ !
তেমার চোখের স্বপ্নগুলো দুঃসময়ের মধ্যেও জেগে থাকে আজকাল
আছন্ন সময় ঘিরে রাখে সরল জীবন
লৌকিক জীবন গিলে খায় আত্মার পবিত্র রক্ত;
অতিক্রান্ত স্বপ্নঋতু ভেসে যায় জলডানায়
হেসে ওঠে চোখ আগুন পানের তেষ্টায় ।
স্বপ্ন দেখে দেখে ক্লান্ত চোখ এ্যখন দুঃস্বপ্নের ফসিল !
আলপথ উঠে যাওয়া সড়কের মতোই বুক তোমার
সংস্কৃতি বিলুপ্তির আকুতি মেখে নুয়ে আছে বাবা
তোমার ভাষার বাক্যে কোনো ভাষাই খুঁজে পাই না এ্যাখন
ভাঁজ খুলে শুধু দগ্ধ প্রাণের গন্ধ পাই ।
বাবা ,তোমার চোখের স্বপ্নগুলো মিছিল হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়
ঘেরাও করে প্রকাশ্যে আমার যতো প্রকাশ
আমি বার বার ফিরে যাই অসীম সে হৃদয়তীরে-
শাহজাহান হয়ে যে চোখে তুমি গড়েছিলে তাজমহল
সাজিয়েছিলে তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা
সীতারামের ঘোড়া হয়ে ছুটেছিলে মানসিংহের দূর্গে,
সাজিয়েছিলে আপন আঙিনায় ঈশাখাঁ’র রাজধানী
আমি তোমার সেই সমুদ্রচোখের নিচে নতজানু হয়ে আছি বাবা
তোমার স্বপ্নগুলো আমার চোখে জীবন্ত এক একটি শহিদ মিনার ।
আমি আক্রান্ত এক ভূমিকার নেপথ্যে
সংক্রামক আর এক ভূমিকা লিখি,বাবা
স্বপ্নের শিল্পঘরে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়া রঙিন সে বাণিজ্য ভূমিকা-
বুকের গোপনে গচ্ছিত স্বপ্ন থেকে খুলে নেয় ওরা জীবনের চাকা
শিল্প-সুষমায় বিষ ঢেলে জ্বেলে দ্যায় বুকে কামনার বহ্নি
ক্ষুধার্ত হৃদয়ে স্বপ্ন বিক্রেতা যাদুকরের ঘরে
জীবন সন্ধানে আমিও সুখক্রেতা ক্রীতদাস হয়ে যাই !
বাঁকা পথে ছুটে যাই সরল গন্তব্যে…
তুমি বলতে, লাইফ ইজ নট ডিফিকাল্ট,বাট উই মেক সো !
বর্ণিল সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে
হাসতে হাসতে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম সেদিন
শান্তি-সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান,
পায়ে ঠুকে উল্টে ফেলেছিলাম জীবন বোধের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট !
দূরাতিক্রমের সিঁড়ি ভেঙ্গে
স্খলিত পায়ে
দীর্ঘ যাত্রায় অমি চলছি হেসে ভেসে
আমার নির্মাণ ক্যাবলই ভেঙে যায় ,বাবা
কী যে সুখময় যন্ত্রনা ,ভেঙে যেতে দিতে !
হাসতে হাসতে কতো স্বপ্ন ভেঙেছি তোমার
গোপন হৃদয়ের কতো আনন্দ,সুখ ভেঙে মা’র
জীবন রাঙিয়েছি রক্তাক্ত অন্ধকারে…
”টাইম এ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান”-গুরুগম্ভীর সে কণ্ঠস্বর
হৃদয়ে আমার থেমে থেমে ঝংকার তোলে
দুঃসময়ের বন্ধু কেউ নেই
দুধের বেড়ালেরা এসেছিলো একদা
চেটে-পুটে খেয়ে গ্যাছে ভাঁড়ার
অন্ধকারে ; আমাকে অন্ধ করে-
বুঝিনি ,সময় এ্যাতো অসহায় সময়ের কাছে
অতীত ভুলের মূল্য দেবার তার নাই তো সময়
সামনে এগিয়ে যাবার তার শুধু তাড়া আছে…
ক্ষমা করো ক্ষমা করো বাবা
আমি তোমার স্বপ্ন হন্তারক সন্তান
নিসর্গের আলোক-প্রান্তরে অবাধ্য,অপরিনামদর্শী
শুধু জেনে রেখো নই কু-সন্তান !
মহাপ্রকৃতির মহাপ্রেম আমি, শুধু সময়ের অবহেলা
বাবা, তুমি স্বপ্নলোভী পিতা
আমি তোমার দুঃখমাখা গৌরব !
ঢং ঢং ঢং
বাবার স্বপ্নপোড়া দীর্ঘশ্বাসে বেজে ওঠে সাতান্ন বছর
চোখ থেকে বুক থেকে নিভে আসে ক্রমশ
স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জন বর্ণের কোলাহল
ভোরের নদী- গোধূলির ছায়া -সবুজ তৃণে
কতো রঙিন পালক ফেলে উড়ে যায় সজল চোখের পাখি
স্বপ্নেরঘরে খিল এঁটে আধখোলা জানালায় বাবা তাকিয়ে থাকেন
হেলান দিয়ে পিএফ গ্রাচ্যুইটি,
কোমল হাতে মাঝে মাঝে ছুঁইয়ে দ্যাখেন
বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষরিত সার্ভিসবুক
চোখের অসংখ্য বৈদ্যুতিক তারে ঝুলে থাকে
অন্তর্মুখি স্ত্রী কুমারী কন্যা বেকার সন্তান-সন্তুতি …