পাঁচ.
মিরাজের অফিসটা খুব দূরে না হলেও প্রায়ই দেরি হয় ফিরতে। সেই সময়টুকু যদিও তুবার নিজস্ব কিন্তু সন্ধ্যার পরের সময়টা তাই খুব একা লাগে তুবার, ভয়ও। বাইরে থাকা অবস্থায় বারবার ফোন করা মিরাজ পছন্দ করে না। যেমন পছন্দ করে না ওর কিছু নিয়ে বেশি প্রশ্ন করায়।
এই বাড়িটায় কত বছর হয়ে গেল ওর। রান্নাঘরটা এক প্রান্তে। বিয়ের পরপরই একদিন একা রান্না করছিল তুবা আর তখনই বারান্দা দিয়ে বুলেট ঢুকে পড়ে। কাকতালীয়ভাবে সেই সময়টাই লোডশেডিং চলছিল। মিশমিশে কালো বিড়ালটাকে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে সাক্ষাৎ নরকের প্রাণী বলে মনে হয়েছিল ওর। কোনো শব্দ না করে বিড়ালটা বারান্দার দরজাটার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সবুজ চোখজোড়া মেলে যেন তুবাকে ডাকছিল – আয়, আয় আমার সাথে। আয় না।
সেদিন ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় তুবা। ভাগ্যিস মিরাজ মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাড়িতে ঢোকে। দরজা যদিও বন্ধই ছিল। কলিংবেল টিপেও যখন সাড়াশব্দ পায়নি কোন, তখন মিরাজ চাবি দিয়ে খুলে ফেলে। সেদিন মিরাজ আফ্রাদের বাসায় গিয়েছিল, সেই আগেকার মতো। গল্প করে আসে রেশমা আক্তার আর সরাফ উদ্দিনের সাথে। দুজনই ওকে খুব স্নেহ করেন। ফেরার পথে হয়তো আফ্রার সাথে দেখা করে যায় কখনও। গল্পও হয়।
সেদিনও আফ্রার ওখানেই গিয়েছিল মিরাজ। গল্প জমে গিয়েছিল খুব চারজনে। এক পর্যায়ে রেশমা আর সরাফ উদ্দিন উঠে যান। বসে ছিলো শুধু মিরাজ আর আফ্রা। তখনই তুবাকে ডাকার কথা বলে ও। কিন্তু ফোনে যখন তুবাকে পেলো না, তখন দুজনেই তড়িৎগতিতে পৌঁছে যায় তুবার কাছে আর আবিষ্কার করে ডাইনিং রুমের মেঝেতে। হাসপাতালে নিতে না হলেও ওর জ্ঞান ফিরতে সময় লেগেছিল। পরদিনই বারান্দায় গ্রিল লাগানো হলো। মিরাজ খুব ঠাট্টা করে বললো,
বিড়াল দেখেই অজ্ঞান? বাঘ দেখলে তো হার্ট ফেইল করবে।
তুবা উত্তর দেয়নি। ক্লিষ্ট হাসি হেসেছিল। ওর এই ভুতের ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা মিরাজ জানে। এরপরও ঠাট্টা করে। তুবা বোঝে, ব্যাপারটায় মিরাজের বিরক্তি লাগে, ন্যাকামো মনে করে। আজ প্রথম বাইরের কারও সামনে ঠাট্টাটা করলো। আফ্রা যদিও তুবার এই দূর্বলতাটুকু জানতো, কিন্তু সেটা নিয়ে যে মিরাজ ভাইয়ের এতটা বিরক্তি, ভাবতেই পারেনি। অদ্ভুত তো!
পরের দিনই তুবাকে জিজ্ঞেস করেছিল ও। কোনো গোলমাল হচ্ছে নাকি? কিন্তু তুবা যে মুখ চাপা। কিছুই বুঝলো না আফ্রা।
গোলমাল তো অবশ্যই আছে। তুবা সেটা কাকে বলবে? প্রিয়তম বান্ধবীকেও অনেক কথা বলা যায় না। তুবার সমস্যাটা ওর রান্নাঘরের জানালাটা নিয়ে, যেটা থেকে আফ্রার বাড়ির ছাদ অব্দি দেখা যায়।
ছয়.
শুনছেন?
মৃদু ডাকটা শুনে ঘাড় ঘোরায় ইফতি এবং দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে। আজ অবশ্য সেদিনকার মতোন আক্রমণাত্মক লাগছে না। কিন্তু বিশ্বাস কি? নিঃসন্দেহে কিছুটা ছিটগ্রস্থ। নইলে একজন অচেনা মানুষকে এভাবে অপদস্ত করে? তার ওপর আজও ইফতির দু আঙ্গুলের মাঝে সিগরেট জ্বলছে। ভাবেইনি, এই সন্ধ্যায় কেউ আসবে। কৈফিয়তটা আগেই দিয়ে দেয়া ভালো।
আ’ম রিয়্যালি স্যরি৷ ভেরি, ভেরি স্যরি। আসলে খেয়ালই ছিল না যে এখানে আবার বসে পড়েছি। ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে এদিকটায় চলে এসেছি, টের পাইনি। আমি এক্ষুনিই নেমে যেতাম। এই একটাই ধরিয়েছি, বিশ্বাস করুন।
না, না। আমি আসলে ও কথা বলতে আসিনি।
তারপরও আমি দুঃখিত। ছাদটায় ভাড়াটেদের ঘোরাঘুরি না করার নিয়মটাও জানি। কিন্তু…।
আহ হা! আপনি দেখি একাই বলে যাচ্ছেন। আমি কি একবারও এসব বলেছি? – এবার হেসে ফেলে আফ্রা। বুঝতে পারছে, ছেলেটা ওর সেদিনের আচরণটা মোটেও ভোলেনি। ‘আমি আসলে আপনাকে স্যরি বলতে এসেছিলাম।’
আমাকে! স্যরি…!!! মানে? ঠিক বুঝতে…।
আচ্ছা, আমি কি ‘মানে বই’? আপনি এত ‘মানে, মানে’ করেন কেন?
স্যরি। স্যরি। আর বাধা দেব না। স্যরি। প্লিজ বলুন। আসলে একটু…মানে, ইয়ে…মানে…
আবার মানে? উফ্! যাক। সেদিন আপনার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। সেইজন্য আমি খুবই, খুবই দুঃখিত, ফ্রম হার্ট। আর…আর মোবাইল ফোনটার জন্য আরও অনেকটা দুঃখিত। ওভাবে চমকে না দিলে…। ইশ্! দামি ফোনটা আমার কারণেই ভেঙ্গে গেল। আমার না খুবই লজ্জা লাগছে।
এইবার ইফতিও হেসে ফেলে। সন্ধ্যা আর রাতের এই সন্ধিক্ষণটা খুব রহস্যময়। পুরো পৃথিবীটা কেমন আচমকা বদলে যায়, বদলে যায় মানুষও। আফ্রাকে আজ একদমই অন্যরকম লাগছে এইজন্যই কি?
‘আরে। স্যরি বলছেন কেন? আমি কিছুই মনে করিনি। আর ফোনের কথা বলছেন?’ – এইটুকু বলেই যেন ম্যাজিশিয়ানের মত হিপ পকেট থেকে বের করে সামনে বাড়িয়ে ধরে ফোনটা। নোট ২০ আল্ট্রার বিশাল স্ক্রিন স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে ছিটিকে আসা আভায় চকচক করছে একদম দাগহীনভাবে।
স্ক্রিন প্রটেক্টর ছিল। বেঁচে গেছে এইজন্য। কাজেই আপনার মন খারাপের কোনো কারণই রইলো না, বুঝলেন?
থ্যাংক য়্যু…ইয়ে…
বলেই একটু থমকায় আফ্রা। ছেলেটা নামটা কী যেন বলেছিল? ওর মনের কথাটা বুঝেই যেন ছেলেটা চোখে দুষ্টুমিটা ঝলসে ওঠে।
সেদিন যেরকম রেগে ছিলেন, আমার নামটা শুনলেও মনে থাকার কথা না। কাজেই আজ আরেকবার আনুষ্ঠানিক পরিচয় হোক। আমি হাসিব ইফতেখার। বন্ধুরা ইফতি বলে ডাকে। আপনার নাম অবশ্য আমি জানি, যদিও সেদিন বলেননি, কিন্তু জানি। আফ্রা, তাই তো?
কীভাবে জানলেন?
নিচে লেখা ফোর-এ এর নেইম প্লেটে আপনার পুরো নামটা আছে যদিও কিন্তু ডাক নামটা জেনেছি সেদিন আপনার মা’র ডাক থেকে। গত পরশু আপনি বোধ হয় মোবাইলটা ফেলেই নেমে গিয়েছিলেন। বারান্দা থেকে উনি ডাকলেন আপনাকে। আমিও তখন আমাদের বারান্দাতেই ছিলাম।
হুমম…। ইন্টেলিজেন্ট। সেদিন আসলে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি আপনার সাথে। পরে ইদ্রিস চাচার কাছে জানলাম আপনি ওনার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এ কথাটা বললেই হতো। ইদ্রিস চাচা আমাকে যে কি আদর করেন। আমি না খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছি ওঁর কাছে।
বলার কি কোন সুযোগ ছিল সেদিন? – হা হা করে হেসে ফেলে এবার ইফতি। আফ্রাও যোগ দেয়। ছেলেটার মধ্যে সহজ একটা ব্যাপার আছে কোথায়। চেনা চেনা মনে হয়।
তারপর আর কি? যেভাবে দুটো সদ্য পরিচিত মানুষ আলাপ শুরু করে, ওদেরটাও তেমনিই শুরু হয়। ইফতি এ বাসায় উঠেছে দোতলার ইদ্রিস সাহেবের রেফরেন্সে। উনি আফ্রার বাবার প্রতিবেশি এবং বন্ধুও। ইফতি ওই ইদ্রিস সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ কলিগের কাজিন। এতদিন ঢাকার বাইরে ছিল। এখন হেড অফিসে চলে এসেছে।
কথায় কথায় আরও জানা গেল, ইফতির বাবা মা নিজের শহর টাঙ্গাইলেই থাকেন, বড় মেয়ের সাথে। ওর চাকরিটা একটা ডেভলপমেন্ট ফার্মে। বেশবঘোরাঘুরির মধ্যে থাকতে হয় মাসের বড় একটা অংশ। বাকি সময়টা ঢাকার অফিসে আর বাসায় কাজে কেটে যায়। নেশা বলতে একটাই, বই পড়া আর মুভি দেখা।
এই লাস্ট লাইনেই আফ্রা মুগ্ধ। বইয়ের পাগল তো ও-ও। দুজনের পছন্দ এক জায়গায় মিলতে আর সময় লাগেনি। আফ্রা তখন ওর গল্প বলে, ওর শৈশবের গল্প, য়্যুনিভার্সিটির গল্প, তুবার গল্প। কথা বলতে বলতে দুজনই এসে দাঁড়িয়েছে রেলিং এর কাছে। সাবধানে পুরোনো রেলিংটায় ভর দিয়ে দাঁড়ায় দুজন। তুবাদের বাসাটা দেখা যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালায় তুবার পাশটা দেখতে পেয়ে আফ্রা ডেকে ওঠে,
অ্যাই তুবা, অ্যাই। কী করছিস রে? চলে আয় না?
দূর থেকে তুবাও হাত নাড়ে। ‘আজ না। মিরাজ চলে আসবে আরেকটু পর। নাস্তা বানাতে হবে।’
অ্যাই শোন না, এ হচ্ছে ইফতি। তুই আসলে পরিচয় করিয়ে দেব।
তুবা এবার কী বলে, ঠিক শোনা যায় না। তখনই একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছিল। তবে ওর হাত নাড়ার বদলে ইফতিও হাত নাড়ে।
পাশ থেকে আফ্রার গালে আলো এসে পড়েছে। জ্বলজ্বলে চোখদুটোয় অকৃত্রিম আনন্দ। ইফতির বুঝতে একবিন্দুও সমস্যা হয় না, প্রাণের বন্ধু কীভাবে ভালোবাসার আলোড়ন তুলতে পারে। মুগ্ধ চোখে এই অদ্ভুত, পাগলামতন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো ইফতি।
সাত.
একটা ময়াল সাপ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে তুবার। মুখের ওপর এসে পড়ছে দুর্গন্ধময় বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
হাঁসফাঁস করে জেগে উঠে বড় করে দম নেয় একবার। স্বপ্নে দেখা সাপ না। বরং তার থেকেও বড় দুঃস্বপ্ন অভিনীত হয়ে চলছে এই মুহূর্তে ওর ওপর। এ এক এমন নাটক, যাতে ওর বাধা দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। আদিম কোনো প্রাণীর মতো ওকে খুঁড়ে চলেছে মিরাজ। সামান্যতম বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেই মিরাজের হিংস্রতা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। বাইরে থেকে খুব স্বাভাবিক, ভদ্র মানুষটার এই আরেকটা চেহারা তুবা ছাড়া আর কেউ কোনোদিন দেখেনি, জানবেও না। আর জানালেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে মিরাজ একজন ভয়ংকররকমের স্যাডিস্ট।
আগাগোড়া হোস্টেলে কাটানো মিরাজের বাবা-মা দু’জনই শৈশবেই মারা গিয়েছেন। একমাত্র সন্তান বলে পিতৃদেব যে অশেষ বিত্ত রেখে গিয়েছিলেন, তা তো নয়ই। বরং মারা যাওয়ার পর দেখা গেল অনেকের বিত্তই তাঁর কাছে ছিল। অর্থাৎ ধার। ফলে চোখের পলকে অবশিষ্ট খুদকুঁড়োগুলো হাওয়া হয়ে গেল। এক দূর সম্পর্কের চাচা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রেখেছিলেন নিজের কাছে। অবশ্য অত্যন্ত অনিচ্ছায় কারণ তাঁর নিজেরই চারটি সন্তান এবং মাসিক আয় দিয়ে দু’মুঠো জোটাতেই জিভ বেরিয়ে যেত। তাই একটা ফ্রি মিশনারি স্কুল দেখে সেখানে প্রথম ক্ষেপেই চালান করে দিলেন হতভাগাটাকে।
অক্ষরের সাথে মিরাজের বন্ধুত্ব হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে। দুজনের সাবজেক্ট একই – পরিসংখ্যান। যেদিন এক উঠতি পাতি নেতা ধার না দেয়ার অপরাধে কলার ধরে ঝাঁকাতে দেখল, ডাকাবুকো অক্ষরের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। অক্ষর সেদিন জুয়েল, মানে পাতি নেতাকে খুব ঠান্ডা স্বরে থামিয়ে না দিলে মিরাজের খবর ছিল। অক্ষর এমনিতে ক্লাসে পপুলার। নেতা আর তাকে ঘাঁটায় নি। মাঝখান থেকে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল মিরাজ আর অক্ষরের মধ্যে। আস্তে আস্তে অক্ষরের বাসায় আসা যাওয়া শুরু হলো। চেনা পরিচয় হলো সবার সাথে, এমনকি আফ্রার অরাণের বান্ধবী তুবার সাথেও।
বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় তুবার মনে হয়েছিল, মিরাজের বড় রকমের কোনো একটা সমস্যা আছে। খটকাটা লাগতো যখন ওই সময়টা তুবাকে কষ্ট দিয়ে যেন ওর আনন্দ আরও বেড়ে যেত। প্রচন্ড বিস্ময়ে এরপর আবিষ্কার করে তুবা, ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই মিরাজের। তার দরকারটুকু শুধু সে উঠিয়ে নিচ্ছে, তা সে যখনই লাগুক না কেন। তুবা কি অসুস্থ, নাকি ক্লান্ত, নাকি ঘুমন্ত, নাকি মন খারাপ – কিছুই ম্যাটার করে না মিরাজের কাছে। খুব কোমল, অসাধারণ আনন্দময় একটা ব্যাপার যে বিভৎসরকমের নারকীয় করে তোলা সম্ভব, সেটা বোধহয় মিরাজ ছাড়া আর কেউ পারবে না। যদিও অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল হয়েছে উলটো। মিরাজ বাড়িয়ে দিয়েছে বিকৃতি।
এইটুকু পর্যন্ত হলেও সম্ভবত তুবা হয়তো মানিয়ে নিত। মেয়েরা অনেকটুকু মানিয়ে নিতে পারে, মেনেও নিতে পারে, তা মন যা-ই বলুক না কেন। সব মানুষ তো একরকম নয়। শারীরিক কষ্টের অংশটুকু না হয় সহ্যই করে নিত ও। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর হলো মিরাজের বলা কথাগুলো। ওই বিশেষ সময়টায় মিরাজ তুবার কানে উগরে দেয় ওর মনের ভয়ংকর সব ফ্যান্টাসিগুলো। তুবাকে দাঁতে দাঁত চেপে শুনে যেতে হয় ওইসব ইচ্ছের কথা। মিরাজ বাধ্য করে ওকে ওই ভুমিকায় অংশ নিতে। এ যে কি অকল্পনীয় নারকীয় মানসিক যন্ত্রণা, সেটা পৃথিবীর অন্য কারও পক্ষে ন্যুনতম কল্পনা করাও অসম্ভব।
ওই যে বলে না, নরকে মানুষকে বারবার মৃত্যুর স্বাদ দেয়া হবে? মিরাজ সেটাই করে তুবাকে, প্রতিরাতেই, একটা বিশেষ নামে ডেকে। চারদিক থেকে দলা পাকানো ঘৃণা তুবাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলতে থাকে।
কী করবে তুবা? কি করতে পারে ও?
খুন করবে? কাকে খুন করবে?
নিজেকে? মিরাজকে? নাকি ওই অন্যজনকে?
আট.
‘আজকে ওকে বলতেই হবে কথাটা। আর পারছি না। উঁহু, অসম্ভব।’
তিনটা আলাদা মানুষ কাকতালীয়ভাবে ঠিক একই চিন্তা করছে, একজনকে কেন্দ্র করেই। পার্থক্য কেবল প্রত্যেকের উদ্দেশ্য, মানসিক অবস্থা আর পরিস্থিতিতে। তিনজনই ভাবছে, কথাটা শুনে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে – সম্পর্কের শেষ? না কি নতুন মাত্রা যোগ হবে সম্পর্কে?
আলাদা তিনটি দিনে আলাদা তিনজন মানুষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজেকে উন্মুক্ত করলো ওই বিশেষ ব্যক্তিটির কাছে। একান্তেই, কারণ দ্বিতীয় কারও উপস্থিতি খুব সাবধানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। শুধু বেছে নেয়া সময়টা ছিল ময়ুরকন্ঠী রাতের আড়ালে। তারপর…?
সেই সকালটায় আকাশে পেঁজা পেঁজা মেঘ জমেছিল অনেক। খুব মিষ্টি, মন ফুরফুরে করে দেয়া একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। আটত্রিশ নম্বর জুম্মন কোচোয়ান লেন তখন সবে জাগতে শুরু করেছে। রোজকার মর্নিং ওয়কে বেরোচ্ছেন ইদ্রিস সাহেব ও তাঁর স্ত্রী। এই পাড়ায় এঁরাই প্রথম জাগেন। সদর দরজা পেরোতেই বোঁ করে মাথাটা ঘুরে উঠলো ওঁর৷ মুহূর্তেই গলা বেয়ে বমি উঠে এসেছে৷ ততক্ষনে ওনার স্ত্রীর গগনবিদারী চিৎকারটা পুরো লেন কাঁপিয়ে দিলেও ইদ্রিস সাহেব স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে।
ছাল ওঠা পিচের রাস্তাটায় অচেনা এক মহাদেশের ম্যাপ তৈরি করেছে গাঢ় কালচে লাল একটা তরল। অবশ্য এখন আর সেটা তরল নেই। প্রায় জমে শক্ত হয়ে কোঁকড়া চুলগুলোকে জট পাকিয়ে আটকে ফেলেছে রাস্তার সাথে। শুধু খোলা চোখদুটো সটান বিছানো সামনের দিকে। কপালের চামড়ার উঁচুনিচু অসামঞ্জস্যতাই বুঝিয়ে দেয়, ছতলার ওপর থেকে পড়ার ধাক্কা খুলিটা আর নিতে পারেনি।
কালো রক্তের মধ্যে আফ্রার প্রায় এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাওয়া মাথাটায় এখনও আটকে আছে হলুদ হেয়ারব্যান্ডটা। যেন গাঢ় বেগুনি ঝোপের মধ্যে হলুদ একটা ফুল ফুটে আছে।
গল্পটা এখানে শেষ করে দেয়া যায়। কিন্তু গল্পটা তো আসলে আমার নয়। তুবা, ইফতি, আফ্রা আর মিরাজ ওদের কাহিনী কিভাবে শেষ করতে চেয়েছিল বা করেছিল, সেটা আমিও জানি না। নগন্য এই লেখক কেবল ওদের জায়গাটা থেকে দেখার চেষ্টাই করতে পারে। ঠিক যেভাবে সিনেমা হলের পিছনের সিটে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দর্শকের আর কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই।
চলবে…