মতিঝিলের একটি বাণিজ্যিক ভবনের ৭ম তলার পশ্চিম দিকে খন্দকার আমীন সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিভিন্ন টেক্সটাইল মিলের তুলা আমদানীর পরিদর্শক হিসেবে কাজ করছে। সেই প্রতিষ্ঠানে ১২/১৩ বছরের হাসান পিয়ন হিসেবে কর্মরত। চাকরি বলতে কর্মস্থানের যে ধরনের শর্ত এবং তাকে কেন্দ্র করে চুক্তি সম্পন্ন বুঝায়, হাসানের জন্য কোনো শর্ত বা চুক্তি প্রযোজ্য নয়। শুধু হাসান নয়, তার মত কয়েক লক্ষ শিশু শ্রমিকের জন্য চাকরি বলতে মৌখিক চুক্তি ছাড়া আর কোনো শর্ত বা লিখিত নিয়মাবলী আরোপ হয় না। এই রকম অলিখিত নিয়ম মেনে ২০০০ সনের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হাসান কাজে যোগ দিল। মাসিক বেতন ৬০০ টাকা।
সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা ছিল হাসানের জন্য নির্ধারতি কর্মঘন্টা। সেই অফিসে কাজ শুরু করার কিছু দিন আগে পরিচিত এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার করে আরামবাগের একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম তুলেছিল। বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও যায়। সারা দিন পিয়নের কাজ করে হাসান সন্ধ্যায় সে নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যেত। অফিসে পিয়নের চাকরি করে সন্ধ্যাকালীন পড়াশুনা হাসানের কাছে ভালোই লাগত।
হাসান কয়েক বছরে নৈশ বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে অষ্টম শ্রেণী পাস করে ফেলেছে। এর পর আর ঐ বিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ নাই। ২০০৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে হটাৎ একদিন হাসানের সঙ্গে দেখা। সে দিন হাসান উত্তর কমলাপুর কবি জসিম উদ্দীন রোড ধরে মতিঝিল বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল। হাতে পলিথিনের একটি স্বচ্চ ব্যাগ। সেই ব্যাগের ভেতর নতুন পেন্সিল, কলম, স্কেল আর বোর্ড পরীক্ষার কাগজপত্র।
তার দিকে দূর থেকে তাকাতেই সেই দৌড়ে কাছে এল। তার সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নাই। তারপরেও সে আমাকে বড় ভাই হিসেবে জ্ঞান করে। বললাম, কিরে কেমন আছিস? সে স্বভাবসূলভ ভঙিতে জানাল তার নিজের কথা। সব কথা শুনে এটা বুঝালাম যে, হাসান কমলাপুর রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিবে। অফিস থেকে কিছু টাকা অনুদান পেয়ে সেই টাকায় বোর্ড রেজিস্ট্রেশনও করে ফেলেছে। পরীক্ষার মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। এই মুহুর্তে হাসানের দিন রাত পড়াশুনা চাই। পড়াশুনার সুবিধার জন্য নিজের ছোটভাইকেও অফিসের কাজে যুক্ত করেছে। গত কয়েক মাস ধরে দুই ভাই একই অফিসে কাজ করছে। দুইজনে কাজ করে মাস শেষে বেতন পাচ্ছে একজন।
দুইজনের কথা বার্তার এক ফাঁকে আমি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলাম। তারপর বললাম, তাহলে তোর অফিস?
সে উত্তর দিল, আমি অফিস থেকে ছুটি চাইছিলাম। কিন্তু তারা না করে দিছে।
কথায় কথায় জানলাম, হাসান অফিসের ম্যানেজারকে তার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ছুটির কথা বলেছিল। সেটিও আবার বিনা বেতনের ছুটি। ম্যানেজারকে তার ছোট ভাই অফিসে কাজ করবে সেই কথাও বলেছে। সাথে জানিয়েছিল হাসানের সব পরীক্ষা শেষ হয়ে আসলে আবার অফিসে ফিরে আসবে।
হাসান অনেক ভেবে চিন্তে ম্যানেজার সাহেবকে তার প্রস্তাবের কথা বলল। ম্যানেজার কয়েক দফা হাসানকে বুঝিয়ে বলার পর অফিসের কাজের ফাঁকে সকলের বস আমীন সাহেবকে বিষয়টি জানালেন। উত্তরে আমীন সাহেব তাৎক্ষণিক তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। বললেন, হাসানের ছুটি মিলবে না। তাকে প্রতিদিন পরীক্ষা শেষ করে অফিসে চলে আসতে হবে।
আমি বালক মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। হাসান দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ রেখে দুই চোখ জলে ভরে তুলল।
সে জানাল, বসের কথা শুনে প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। নিজেকে প্রশ্ন বহুবার সে করেছে। হাসান ভাবতেই পারছিল না যে গত ছয়টি বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছিল সেখানে কয়েক সপ্তাহের ছুটি মিলবে না কেন!
হাসান নিরুপায় ছিল। অফিস থেকে মাস শেষে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে চার জনের সংসারের মাস চলে যেত। হাতে সঞ্চয় করা নগদ চার হাজার টাকা ছিল শেষ সম্বল।
হাসানের অফিসে তার জন্য একটি ছোট কামরা আছে। সেটি মূলত ৭ম তলার জন্য বৈদ্যুতিক মিটার রাখার ঘর। সেখানে হাসানকে অফিসের সকলের জন্য সকাল, দুপুর, মাঝে মধ্যে সন্ধ্যায় চা বানাতে হত। দুপুরের খাবারের জন্য সেই ঘরে সব সময় খাবারের প্লেট আর চা পানের জন্য জিনিসপত্রের বন্দোবস্ত তৈরি রাখতে হত।
হাসানের পরীক্ষা মার্চ মাসের ৬ তারিখ থেকে। তার আগের মাস ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে অফিস থেকে বলা হয়েছে হাসানের ছুটি মিলবে না। কিন্তু হাসান এরই মধ্যে ম্যানেজারকে জানিয়ে দিয়েছে যে ছুটি না পেলে অফিসের পিয়নের চাকরি আর সে করবে না।
হাসান নিজের কক্ষে গিয়ে টেবিলে লেগে থাকা তরকারির ঝোল, চা পানের কাপ সরিয়ে সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে বসেছে। উদ্দেশ্য “চাকরি থেকে অব্যহতি চাই”- এই মর্মে আবেদনপত্র লেখা শুরু করল। হাসানের হাত কাঁপছে। অবসন্ন হয়ে আসছে দেহ। দুই তিন বার কাগজ নষ্ট করল। এরপর বড় বড় অক্ষরে লিখে চলেছে রিজাইন লেটার। লেখা শেষ হলে হাসান ম্যানেজারকে দেখালেন। ম্যানেজার হাসানের রিজাইন লেটারে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন চিঠিটি ভেতরে বসের টেবিলে রেখে আসতে। হাসানের এই চিঠি লেখার ফাঁকে আমীন সাহেব তখন পাশের অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
হাসান জীবনের প্রথম রিজাইন লেটার লিখল। লিখে দ্রুত বেগে আমীন সাহেবের টেবিলে রেখে চলে আসল। এরপর দৈনিক রুটিন মাফিক কাগজপত্রের ফটোকপি করার জন্য ৭ম তলা ভবনের নীচে চলে এল।
তখন সন্ধ্যা বেশ আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। চারিদিকের অন্ধকার বাড়ছে। শেষ বিকালের কাজের চাপ আর রিজাইন লেটারের বিষয়টি হাসানকে অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলেছে।
অফিসের লিফট বন্ধ।
কাগজপত্রের ফটোকপির কাজ শেষ করে হাসান তার ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ভবনের দ্বিতীয় তলা অতিক্রম করে তৃতীয় তলায় পা দিতেই আমীন সাহেবের সাথে হাসানের দেখা হয়ে গেল। আমীন সাহেব অফিস ছেড়ে নেমে যাওয়ার পথে ভবনের উপর থেকে নামতে গিয়ে হাসানের সামনে এসে দাঁড়াল।
লোকটিকে হাসান অনেক ভাবেই ভয় পায়। হাসানের মুখে কোন কথা। উল্টো মনে মনে ভাবছে মোস্তফা সাহেব নিশ্চয়ই তার রিজাইন লেটারের বিষয়ে অবহিত আছেন।
মোস্তফা বললেন, শুনেছি তুমি নাকি আর চাকরি করবা না।
হাসান আমীন সাহেবের মুখের দিকে তাকানোর আগেই আমীন সাহেব পূণরায় বললেন,
শুনে রাখো, তোমরা দুই ভাইয়ে যদি আমার অফিসে চাকরি না কর তাহলে ঢাকা শহরে ভাত পাবে না।
আমীন সাহেব হাসানের চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হবার কয়েক মিনিটের মাথায় হাসান দৌড়ে অফিসের ৭ম তলায় পৌছে গেল। অফিসের সব চাবি ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে আসল। এর পর আর কোন দিন হাসানকে মতিঝিলের অফিস পাড়ায় দেখা যায় নি।
নিয়ামত আলী
জন্ম তারিখ- ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায়।
একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কর্ভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরিতে পিএইচডি করছেন।