লম্বা জার্নির পর টানা দশ ঘন্টা ঘুম,তবু মাথাটা বুদ হয় আছে। ব্যালকনিতে এসে বসল মিথিলা। গতকাল এয়ারপোর্টে নেমে অনিরুদ্ধর সাথে সাধারণ সৌজন্যতাটুকু না সেরেই ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে। সম্পর্কটা ঝেড়ে বা ছিঁড়ে ফেলার মতো জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে হোক, এগোনোর আর পথ কোথায়?
ফোনটা নিয়ে নোটিশগুলি চেক করল মিথিলা। নাহ্, একগাঁদা নোটিশের ভিড়ে অনিরুদ্ধ সেন নেই। মাপা পার্সনালিটির অনিরুদ্ধ সেনের কাছ থেকে এটাই কাঙ্খিত আচরণ। অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম কুক মেয়েটা ব্ল্যাক কফি নিয়ে নিয়ে এল।
‘অফিস যাবেন ম্যাডাম?’
‘যাব, স্নানঘর রেডি কর আসছি। মাকে তো দেখছিনা, মা কোথায় আছেন?’
‘কলেজে চলে গেছেন,মিটিং আছে। ঘুমোচ্ছেন বলে ডাকেননি। আপনাকে বলতে বলে গেছেন।’
‘ও আচ্ছা।’
মায়ের মুখোমুখি হতে ভয় হচ্ছে মিথিলার। অফিসিয়াল ট্যুর ছিল কক্সবাজারে, অনিরুদ্ধও সঙ্গী হয়েছিল। মাকে অনিরুদ্ধর কথা বলেছে সে। মেয়ের সুখের কথা ভেবেই ধর্মীয় দুরত্ব থাকা সত্ত্বেও মা অনিরুদ্ধকে মেনে নিয়েছে । কক্সবাজার থেকে এসেই বিয়ে নিয়ে অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলার কথা। সেও কথা দিয়েছিল মাকে,বিয়ে নিয়ে আর বাহানা করবেনা। এখন মা যদি অনিরুদ্ধর প্রসঙ্গ নিয়ে জিজ্ঞেস করে? কি বলবে সে? কুয়াকাটার সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অনিরুদ্ধও হারিয়ে গেছে?
আর অনিরুদ্ধ? ‘বিশ্বাস কর, বার বার বলতে চেয়েছি; তুমি কষ্ট পাবে বলে বলেনি। তাছাড়া নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত।’ অনিরুদ্ধর চোখে মুখে আকুলতা।
‘উফ্ প্লিজ,ন্যাকামো করোনা । এতদিনে এতকিছুর পর একথা বলছ? না-না না-তুমি এটা করতে পারনা,আমাকে এভাবে গুড়িয়ে দিতে পার না।’ মিথিলা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। যেন হঠাৎ ঝড়ের ঝাপটায় ভেঙে পড়া মানুষ।
‘আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ’হাত জোড় করে অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে।
শুধুই ক্ষমা ? প্রতারণা নয়-স্ত্রী সন্তানের কথা গোপন করে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করা? এতদুর এগোনোর পর বলছে ‘নেক্সট মান্থে ওরা মফস্বল ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকবে। প্লিজ ক্ষমা করো, আমি ওদেরকে নিয়ে সুখি হতে চাই’ মিথিলার জন্য নয়,ওদের জন্যই অনিরুদ্ধর এই ফ্ল্যাট কেনা!
এক’ঘন্টার ব্যবধানে মনে হচ্ছে, অনিরুদ্ধর কাছে এতটা নতজানু হবার কী প্রয়োজন ছিল ? এতটুকু দূর্বলতা না দেখালেই ভাল হতো। কারো জীবন কেউ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারেনা। নদীভাঙা মানুষও ভাসতে ভাসতে বেঁচে থাকে- হোক তা যতই নিঃসহায়-নিঃসম্বল।
দুই
লোকটার পার্সোনালিটি, বুদ্ধির তিক্ষ্ণতা, কথা বলায় বিনয়–শিষ্টাচার-সৌজন্যতা, বলার ঢং,বলতে গেলে লোকটার প্রতি একধরণের মুগ্ধতা ছিল মিথিলার। কিন্তু ছ’মাসে ন’মাসে দেখা, আর হাই-হ্যালোর মধ্য ছিল সম্পর্কের পরিধিটা। কেন যে ফেসবুকে লোকটার গল্পটা নিয়ে মন্তব্য করতে গেল সে! কত জনেই তো কত কী লিখছে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়। কী দরকার ছিল কমেন্ট করার? ‘নবনীতাকে অবনির সাথে প্রেমে না জড়ালে হতোনা ? এটা সামাজিক নৈতিকতার বিরুদ্ধে টিনেজদের উস্কে দেয়া নয়? এর পরিণতি ভেবেছেন? তাছাড়া তিন সন্তানের বাবা; হোক সে কবি-লেখক তার জন্য একজন ভার্জিন পাগল প্রায়, এমন গাঁজাখুড়ি গল্প না লিখে সমাজের সমস্যাগুলি,নারীদের সমস্যাগুলি নিয়ে লিখুন।’অনিরুদ্ধ জবাব দিল‘লেখক শুধু সমাজে যা ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা,তা লিখে যায়।গ্রহণ বর্জনের দায় লেখকের নয়।তাছাড়া স্বাভাবিক সম্পর্কের ভেতর যারা নীতি-নৈতিকতা সামাজিকতা খুঁজে, তাদের সাথে আলোচনায় আমার আগ্রহ নেই।’
এরপর দুজনের দিক থেকে আক্রমণ,পাল্টা আক্রমণও কম হয়নি।
রাগ নাকি অনুরাগের আয়না। শেষ পর্যন্ত অনিরুদ্ধ সেনের সাহিত্য পত্রিকা ‘ধ্রবতারা’ মিথিলার কবিতা ছাপল। পত্রিকা পাঠিয়ে অনিরুদ্ধ মেসেঞ্জারে লিখল ‘পত্রিকাটি সম্পর্কে মতামত আশা করছি।’
মিথিলা লিখেছিল ‘কাগজের পরিসর পরিধি নয় বরং মানসম্মত লিখাই পত্রিকার উৎকৃষ্টতা বিচারের নির্ধারক। ধ্রবতারা-র লিখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এর প্রাধান্য স্পষ্ট। প্রতিটি লিখাই প্রগতিশীল মূল্যবোধকে প্রতিনিধিত্ব করছে। পুঁজিবাদের রক্তে মশার আখড়া, মরাগাঙের চরে বেনারসি ব্রিজ,শিল্প সাহিত্যের বিকৃত রুচি বিকার, পুঁজিবাদের সংকট;বিষয়বস্তুর প্রাধান্য তো বটেই, এর প্রচ্ছদ, অবয়বের শিল্পবোধেও মুগ্ধ। ধ্রুবতারা-আগামীর প্রত্যাশা পূরণ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
তারপর আর কিছু থেমে থাকেনি, অবসরে চ্যাট। বিশেষ করে মিথিলা অফিস থেকে ফেরার পর রাতে।
কী করছেন?
এইতো, পড়ছি।
ডিস্টার্ব করলাম?
-নাতো,পড়ছিলাম।সেটা তো পরেও করা যাবে।গুরুত্বপূর্ণ একজনের সাথে কি ইচ্ছে হলেই কথা বলা যায়?
-কী যে বলেন!অনিরুদ্ধ ভণিতা করে।প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলে‘ নতুন কিছু লিখছেন ?নেক্সট সংখ্যায় লিখা আশা করছি।
-হু পাঠাবো,আপনি?নতুন গল্প কিংবা উপন্যাস?
-আসুননা একদিন, শ্রোতা পেলে মন্দ হয়না।
-দেখি আসবো, সাহিত্য আড্ডা হলো সাহিত্যের রসদ,নতুন লিখা নিয়ে আলোচনাও করা হবে।
ক্রমশঃ সম্পর্কটা তুমি তে এসে গিয়েছিল।দুজন যেন দুজনের কতকালের চেনা!
এই, চলনা জোছনা স্নান করি।
সেটা কিভাবে?
আজ শুক্লা চতুর্দশী না!
তো?
জোছনায় ভাসবো দুজন, চলে এসো।
ধ্যুত, এত রাতে?
তাহলে ছাদে যাও।
পারবো না, আলেসেমি লাগেছে। নাইটি পড়ে আছি। ছাদে লোক থাকে।
বেশ আছো, দেখতে ইচ্ছে করছে।
অসভ্য!
যা থেকে নতুন প্রজন্মের, নতুন জীবনের সৃষ্টি, তা নিয়ে আলোচনা অসভ্যতা হতে পারে না।
তবু,লজ্জা লাগছে।
ঠিক আছে, তোমার বারান্দায় এসো। এবার ইউক্যালিপটাস গাছটাকে চল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে দাঁড়াও।
দাঁড়ালাম।
নিজেকে জোছনা পরী মনে হচ্ছে না?
হু,নাচতে ইচ্ছে করছে খুব। এখানে জায়গা কম।
সেই জন্যই তো বললাম ছাদে আস। আমিও আমার ছাদে সটান শুয়ে জোছনা স্নান করছি। একই চাঁদ দুজনে একই সময়ে দেখা এটাকে কী বলে?
জানি না।
কাছে এলে বলবো।
যাহ্, খুব দুষ্ট হয়েছ।
তারপর কিভাবে যেন আরো এগিয়ে যায় সম্পর্কটা। দুজন দুজনের প্রতি শুধুই মুগ্ধতা। সময় পেলেই আড্ডা, ঘুরাঘুরি, হুট-হাট অনিরুদ্ধর ফ্ল্যাটে চলে যাওয়া….।
মিথিলার দুটি বই বের হয়েছে ততোদিনে। অনিরুদ্ধই খেটে-খুঁটে করেছে। অনিরুদ্ধ না থাকলে শখের কবিতার বই আর মিথিলা কবি স্বীকৃতি পেতো কিনা, কে জানে! সেই অনিরুদ্ধ ছাড়া তাকে চলতে হবে, গতকাল পর্যন্ত যে তার সবকিছু ছিল, আজ তাকে ভুলে যেতে হবে? এত ঘনিষ্ঠতা, এত কাছাকাছি আসা, হয়তো কোনো কমিটমেন্ট ছিল না; বিয়ে কিংবা আগামীর। অনিরুদ্ধর সাথে সম্পর্কটা চলতে চলতে হয়ে গেছে। তবু মিথিলা স্বপ্ন দেখেছিল। কেন করলো অনিরুদ্ধ এটা-এক জীবনের আড়ালে অন্য জীবন, সম্পর্কের আড়ালে সম্পর্ক? কী লাভ হল মিথিলাকে আহত করে? ভাবতে ভাবতে মিথিলা চমকালো। অনিরুদ্ধ সেন তাকে লেসন দিয়ে গেল না তো? মানে যা দিয়ে সম্পর্কের শুরুটা!
তিন
‘ম্যাডাম, অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ।’ রিতার কথায় ঘড়ি দেখল মিথিলা।
‘ইস্,বড্ড দেরী হয়ে গেছে, আসছি’
‘ম্যাডাম, এখনো নাস্তা করেননি, দশটা বাজে।’
মিথিলা দ্রুত রেডি হয়ে গাড়িতে উঠলো। আজ অফিস থেকে ছুটি নেয়া যেতো অনায়াসেই। কিন্তু কোন স্থবিরতাকেই সে প্রশ্রয় দিতে চায় না। তাই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। অনিরুদ্ধ ভাবনা থেকে সে বেরোতে চায়। গাড়িতে উঠার পর পরই মায়ের ফোন-
হ্যালো বেবি, গুড মরনিং ।
ভেরি গুড মরনিং, মাই সুইট মাদার ।
কলেজে মিটিং আছে, তোমাকে না বলেই চলে আসতে হলো, বেবি। আমি রিতাকে বলে আসছি,তোমাকে বলতে।
ওকে মা,সন্ধ্যায় দেখা হবে।অফিসে যাচ্ছি।
‘শোন,যার জন্য ফোন করেছি, ময়মনসিংহ থেকে তোমার মামারা আসছেন। একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে। বিয়ে নিয়ে কথা বলতে ওদেরকে ডেকেছি। আর অনিরুদ্ধকে কাল ডিনারে নিমন্ত্রণ করো, আমার নাম করে। তোমার মামারা দেখুক। পরে আমি ওর ফ্যামিলিতে কথা বলবো।’ মিথিলার মা মেয়ের বিয়ে নিয়ে খুবই সিরিয়াস বুঝা যায়।
হু হু করে গাড়ি ছুটে চলছে। এ ছুটে চলাটাই জীবন। থেমে গেলেই গ্রাস করবে জড়তা-না পাওয়ার, আকাঙ্ক্ষা পরিসমাপ্তি না হওয়ার হতাশা।
হঠাৎই গাড়িটা ব্রেক কষল্। জোরে ঝাকুনি খেলো মিথিলা।
যান জট ম্যাডাম। লম্বা লাইন,কখন যে ছাড়া পাব! ঘুরে যাব ম্যাডাম? ড্রাইভার বলল।
দরকার নেই যা দেরী হওয়ার তো হয়েই গেছে। ঘুরে গেলেই যে স্মোথলি যেতে পারবো তার তো নিশ্চয়তা নেই। বরং অপেক্ষাই করি। এ সি টা বাড়িয়ে দাও।
গাড়ির ভেতর হাসফাঁস করছে মিথিলা। তার জীবনটাও গাড়ির মতো থেমে গেছে হঠাৎ, অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত। মিথিলা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। মায়েরও কী এমন হয়েছিল বাবা মারা যাবার পর? কোনোভাবে মিথিলাকে আঁকড়ে বেঁচে ছিল? জীবন হয়তো এমনি, কারো কারো জীবন কখনো চলতে চলতে বাঁকে এসে থেমে যায়। অস্থির না হয়ে ছুটা ছুটি না করে অপেক্ষা করতে হয়, ক্ষতিটা মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।
অফিস থেকে ফোন-মহিনের।
ম্যাডাম,আজ আর আসবেন না?
আসছি। এই তো ফার্মগেটে, জ্যামে আটকে আছি।কিন্তু কেন?জরুরি কিছু? অফিসে কোনো সমস্যা?
না,এমনি। আসুন। ভাবলাম,আসবেন কিনা!এত জার্নি করে শরীর খারাপ করলো নাতো?
না মাহিন,ভালো আছি। আসছি,কথা হবে।
চাকরিতে এবং বয়সে এক ইয়ার জুনিয়র মাহিন। ছেলেটা মিথিলার বড় ন্যাওটা । কাজ না থাকলেও মিথিলার রুমে এসে বসবে । অফিসে মিথিলাকে মুগ্ধ হয়ে অনুসরণ করবে। অফিস শেষে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিবে।
মিথিলার প্রতি ওর দুর্বলতাটা বোঝা যায়। ওকে এ নিয়ে বকেছেও।কিন্তু সে একই আছে । অফিসে সবাই অনিরুদ্ধর কথা জানে। এ নিয়ে মাহিনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
জ্যামে আটকে থেকে মায়ের কথা, অনিরুদ্ধর কথা ভাবছে মিথিলা। মাকে কী সব সত্যিটা বলে দিবে সে? নাকি বলবে, তোমরা পাত্র দেখ, অথবা বিয়েতে আগ্রহ, আস্থা, কোনটাই আমার নেই।
মিথিলার বাবা ছোটবেলায় রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন । চাচারা আর তেমন কোনো যোগাযোগ রাখেনি। মা নিজের কথা না ভেবে, নিজের কলেজে চাকরি আর মিথিলাকে নিয়েই থেকেছেন। মামাদের সহযোগীতা নিয়ে বড় করেছে মিথিলাকে। এম পাশ করে বেসরকারি ফার্মে বড় পোস্টে চাকরি করছে মিথিলা। এটাই তো স্বাভাবিক যে মেয়ের বিয়ে, সংসার, একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষা তিনি করবেন। এতদিন নানা অজুহাতে অনেক বিয়ের প্রস্তাব ডিনাই করেছে সে। অনিরুদ্ধর প্রতি মেয়ের দুর্বলতা, ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির একজনকে পরিবারে মানিয়ে নিতে মায়ের নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ,আত্মীয় স্বজনের সাথে এ নিয়ে মানসিক দ্বন্ধ, এত কিছুর পর আজ অনিরুদ্ধর এ অবস্থার কথা শুনলে মা কী আহত হবে না? মায়ের এত পরিশ্রম,এত সেক্রিফাইসের মর্যাদা কি সে মায়ের ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে দেবে? তাছাড়া মামারা, আত্মীয় স্বজনরাই কী ভাববে? সবাই যেখানে অনিরুদ্ধর ব্যাপারটা জানে।
চার
অফিসে মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে মিথিলা আর মাহিন। কী বিভোর এক ঘোরের জগতে থাকে ছেলেটা! মিথিলা কখনো এত গভীরভাবে ভাবেনি ওকে নিয়ে, যেন এই প্রথম দেখছে ওকে। বরাবর এড়িয়ে গেছে কিংবা বিরক্ত লেগেছে। আজ ওর জন্য খুব মায়া লাগে। ওর নির্মলতা, মুগ্ধতা অধোবদনতা, স্বার্থপরের মতো ভেঙ্গে খান খান করে ওকে দখল নিতে চাইছে সে। তবু নিরুপায় মিথিলা। খুব, খুবই দ্রুত,যেন ওর সম্মতিসূচক স্বীকারোক্তি আদায় করে নিতে চায় সে।
তুমি আমার সামনে মাথা নিচু করে এমন জড়তা ভাব নিয়ে থাক কেন? অন্যদের সামনে তো খুব স্মার্টলি চল,আমি দেখেছি। তুমি কী জান, তুমি খুব সুন্দর আর্ স্মার্ট?
মাহিন জড়সড় হয়ে বসে থাকে ‘জী ম্যাডাম’।
তুমি আমাকে ভালোবাস?
জী ম্যাডাম, না ম্যাডাম।
জী ম্যাডাম, না ম্যাডাম করছ কেন? সোজাসোজি বলতে পার না?
আপনাকে ভয় করে ম্যাডাম, হাত পা শরীর কাঁপে।
ভয় করলে আমাকে বিয়ে করবে কিভাবে?
জী,জী ম্যাডাম? মাহিন অবাক হয়ে মিথিলার মুখের দিকে তাকায়?
তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
মানে?
হ্যাঁ,স্বার্থপরের মতো বলছি।
তারপর অনিরুদ্ধর কথা,তার মায়ের কথা সব খুলে বলে সে মাহিনকে।
আমি তোমার কাছে হেল্প চাইছি,মাহিন। সব কিছু শোনার পরও বিয়ে করবে আমায়?
জী ম্যডাম। মাহিনের কন্ঠে দৃঢ়তা।
অনিরুদ্ধর সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে একথা শোনার পরও?
সতিত্ব, নারীদের শরীর নিয়ে চিরায়ত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি সহমত পোষণ করি না,ম্যাডাম। আমি সবকিছু বৈজ্ঞানিকভাবে দেখার চেষ্টা করি । আপনিও করবেন। তাহলে এসব কুসংস্কারের থাবা কিংবা সামাজিক বেড়াজাল থেকে আপনি মুক্ত থাকতে পারবেন, জীবনও সহজ সুন্দর হবে।
আমিতো তোমায় ভালোবাসি না, শুধু মায়ের জন্য বিয়ে করতে চাইছি। তোমার খারাপ লাগবে না?
লাগবে না,কারণ আমি তো আপনাকে ভালবাসি। তাছাড়া আপনিও আমাকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন আমি জানি।
সেটা কিভাবে? মিথিলা অবাক হয়ে বলে।
এই যে এত বছর ধরে আপনাকে বিরক্ত করছি। আপনি সহ্য করে নিচ্ছেন এটাও এক ধরণের প্রেম-ভালবাসা। একটা চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলতে এটুকুই যথেষ্ট। এরেঞ্জ মেরেজে তো বলতে গেলে কেউ কাউকে চেনে না। তবু তো বিয়ে টিকে থাকে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দুজনের ইচ্ছে, স্যাক্রিফাইসটাই অনেক বড়।
মাহিনের কথার জড়তা মুহুর্তে কোথাও উধাও হয়ে গেছে? এ কোন মাহিনকে দেখছে সে আজ? এত কিছু বোঝে মাহিন!
তার পরেও বলছি, আজই ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে না। তুমি ভেবে কাল বলো।
পাঁচ
‘সে কী কথা! তুমি না বললে অনিরুদ্ধকে ভালোবাস, তাকে বিয়ে করতে চাও, আমি সে মতে বিয়ের জন্য এগোচ্ছি, আত্মীয় স্বজনকে জানিয়েছি। আজ আবার বলছ মাহিনকে বিয়ে করবে! এটা কী ধরণের হেয়ালি হচ্ছে আমার সাথে? জীবনটা খেলা নয়,বুঝেছ?’ মিথিলার মা খুব রেগে গেলেন।
প্লিজ মা আমাকে ভুল বুঝনা, আমি ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তাহলে অনিরুদ্ধ? তাছাড়া তোমার এ খামখেয়ালিতে ওকে ঠকাচ্ছ,ওর জীবন নষ্ট করছ কেন?
মা, অনিরুদ্ধও তাই চাইছে।
শেষে তোমাদের কষ্ট হবে নাতো বেবি! কী এমন হয়েছে, যে দুজনেই মত পাল্টাচ্ছ? আমাকে খুলে বল। মা কিছুটা নরম হল।
আমি বলতে পারবো না মা, আমি অনিরুদ্ধকে ছোট করতে চাই না।
ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু হুট করে মাহিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নেয়া কী ঠিক হচ্ছে? তুমি বরং আরো সময় নাও।মাহিন সবকিছু জানে?
হ্যাঁ মা, আমি ওকে সব বলেছি। ও সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর বাবা মায়ের সাথেও কথা বলেছে।
ঠিক আছে। আমি ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে তোমার মামাদের নিয়ে ওদের ওখানে যাব।
‘আমার লক্ষ্মী মা।’ মিথিলা মাকে জড়িয়ে ধরল।
এক্সিকিউটিভ অফিসার মিথিলা আহমেদের সাথে জুনিয়র অফিসার মাহিনের এনগেজমেন্ট পার্টিটা সবাই খুব ধুমধাম করে এনজয় করলো। অনিরুদ্ধকে নিয়ে প্রশ্নটা কারো মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও অনুষ্ঠনের উচ্ছাসে ওটা নিয়ে আর কোন বাক্যালাপ কিংবা দু এক জন মিলে এটা নিয়ে কোনো ফিসফিস পর্যন্ত করলো না।
মাহিন এখন অফিসে আরো বেশি প্রাণচঞ্চল, মিথিলার প্রতি আরো বেশি কেয়ারিং। অফিস শেষে এগিয়ে দিচ্ছে, কিংবা বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে মিথিলাকে।বিয়ের কেনাকাটা, প্রস্তুতিও এগোচ্ছে। মিথিলাও চাইছে অনিরুদ্ধর শুন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হোক মাহিন ।
‘আমাদের বাড়িতে যাবে? কোনোদিন তো যাওনি, এনগেজমেন্ট তো তোমাদের বাড়িতে হলো।’ মাহিন একদিন বলল।
তোমাদের বাড়িতে কেউ কিছু ভাববে নাতো?
আম্মু বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। তাছাড়া তোমারও তো দেখা দরকার তুমি কোথায় যাচ্ছ।
ঠিক আছে চল।
মাহিনের ঘরটি খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। একপাশে দেয়ালে ফটো এলবাম-মিথিলা। অফিসের বিভিন্ন সময়ে তোলা মিথিলার ছবি দিয়ে সাজানো এলবামটি। মুগ্ধ ও আশ্চর্য মিথিলা! এসব ছবি মাহিন সংগ্রহ করে রেখেছে? অন্যপাশে দেয়ালে একটি পোর্ট্রেট, ক্যামেরায় তোলা ফোটোগ্রাফ না শিল্পির আাঁকা বোঝা যাচ্ছে না –খুব জীবন্ত। মিথিলা ছবি ভালো বোঝেনা। তবে খুব ভালো লাগছে, ছবির নারী কোন এক আত্মমগ্ন দুরবাসিনী। অবিকল মিথিলার চোখ, মুখ ভ্রু,কেশ-বেশ। তবে এ মিথিলা নয়, অন্য অচেনা কেউ। কপাল বেয়ে নেমে আসা ক্ষীণ চুলের ধারা ছবির নারীকে ফ্রেমবিহীন ত্রিকাল ফ্যাসনে বেঁধেছে।
‘আমার পাগল ছেলেটা কত দিন, কত সময় ধরে এঁকেছে তোমাকে।’ মাহিনের মা এসে পিঠে আলতো হাত রাখে। ‘ওর কষ্ট দেখে আমি বলেছিলাম, তোমার সাথে, তোমার মায়ের সাথে কথা বলি, মাহিন না করেছ। বলেছে-যেদিন তার অন্তরের সাড়া পাব সেদিনই সে আসবে, আমি তার অপেক্ষায় থাকবো। আমরা সবাই তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, মা।’
মিথিলা মুগ্ধ হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। এ ক’দিন আগেও তাকে ভাবতে হয়েছে, অনিরুদ্ধ যেন তার বাঁচার সমস্ত রদস শুষে নিয়ে গেছে। অনিবার্য হয়ে ওঠা এ রুদ্ধ, রুষ্ট,পাথুরে কঠিন জীবন কী করে কাটাবে সে? অনিরুদ্ধর জাদুস্পর্শ কী করে ভুলবে সে? হয়তো জীবন থেকে কোন কিছুই একবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না, জীবনে আশা থাকে, বেঁচে থাকার পথ খোলা থাকে। জীবনে স্থবিরতা আসে, বাঁক বদল হয়। স্থবিরতা মানে নতুন প্রেক্ষাপট, নতুন সম্ভাবনার অপেক্ষা। কে জানতো, মাহিন এভাবে মিথিলাকে দেবী করে নৈবেদ্য সাজিয়ে বসে আছে।
মাহিনের মা কখন চলে গেছেন, মিথিলা খেয়াল করেনি ।
দরজায় দাঁড়িয়ে মাহিন মিটি মিটি হাসছে। বাড়িটায় একটা চমৎকার সুরের আবহ ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো…’